সুমু হক:
ধর্ষণ নিয়ে কথা বলতে বলতে এতো কিছু বলা হয়ে গেছে, যে নতুন কিছু আর নেই। এ যেন কেবলই একটা বন্ধ দরজায় মাথা খুঁড়ে যাওয়া। দরজাটা কিছুতেই খুলবে না, যিনি মাথা খুঁড়ছেন তিনিই রক্তাক্ত হবেন শুধু!
ধর্ষণকে যদি নির্মূল করতে হয়, প্রথমেই যেটা অত্যন্ত জরুরি সেটা হলো যেকোন একজন ব্যক্তির মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়টিকে, প্রেম কিংবা শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার মতামত এবং সম্মতিকে শ্রদ্ধা করা।এখন সমস্যা হ’লো, আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থা এবং ধর্মীয় অনুশাসন, কোনটিই আমাদেরকে ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে শেখায় না, আর নারী, সে তো ব্যক্তি পদবাচ্যই নয়!
গতকালকে কারও স্ট্যাটাসে দেখছিলাম যে তার ক্ষমতা থাকলে তিনি প্রতিটি পুরুষকে সকাল – দুপুর রাত তিনবেলা “Pink” ছবিটি নিয়ম করে দেখাতেন। কিন্তু আদৌ তাতে কিছু হ’তো কি?
ধর্ষকামিতা একটি সামাজিক প্রবণতা। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, সমস্ত পৃথিবী জুড়েই। পর্ন ইন্ডাস্ট্রি থেকে নিয়ে আমাদের বেডরুম পর্যন্ত, বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কথোপকথনের শব্দচয়ন প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই আক্রমণাত্মক মনোভাবের শিকার শিশু, নারী এবং পুরুষেরাও।
কাউকে অপমান করতে হবে, গালিগালাজ করতে হবে, চ -বর্গীয়, খ-বর্গীয় শব্দের বন্যা বয়ে দিলেই হ’লো, এমনকি নারীরাও কম যান না এইক্ষেত্রে। কোন পুরুষকে অপমান করতে হবে, তার মাকে নিয়ে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করে দিলেই হ’লো। ভাবটা এরকম, যে জগৎ-সংসারের সমস্ত মানুষের মান – অপমান বোধ, যাবতীয় পুরুষের পৌরুষ কেবলমাত্র তার পরিবারের নারীদের শারীরিক “শুচিতা”র ভেতরেই নিহিত।
এমন ঠুনকো অপমান এবং তার চেয়েও ঠুনকো পৌরুষবোধ নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে থাকা মানুষেরা এমনকি করুণারও যোগ্য নয়! প্রেম- শরীর যৌনতা, এই বিষয়গুলোকে আমরা যতদিন খোলা চোখে দেখতে এবং জীবনের স্বাভাবিক অংশ বলে জানতে না শিখবো, ততদিন দমিয়ে রাখা যৌনতা এইরকম নানারকম কুৎসিত কদর্য পথে প্রকাশিত হতেই থাকবে।
যতদিন আমরা আমাদের মেয়েদেরকে শেখাবো, তার যাবতীয় আত্মসম্মান, আইডেন্টিটি এমনকি তার চৌদ্দ পুরুষের সম্মান রক্ষার দায় শুধুমাত্র তার শরীরের ওই একটি অংশের, ধর্ষণ চলতে থাকবেই। যতদিন আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের শেখাবো, শরীর ভীষণ নোংরা বিষয়, অস্পৃশ্য, শরীরের সম্পর্কের চেয়ে পাপময় কিছু নেই, ধর্ষণ বন্ধ হবে না।
যতদিন আমরা একদিকে মেয়েদেরকে শেখাবো, তাদের শরীরটি সমস্ত পাপের উৎস, তাই তাকেই এই শরীর ঢেকে রেখে জগতের সমস্ত লোভাতুর পুরুষের চরিত্রস্খলন ঠেকানোর দায় নিতে হবে, ততদিন তাদেরকে কেউ মানুষ কিংবা তাদের শরীরকেও মানুষের শরীর বলে জানবে না।
যতদিন আমরা স্কুল-কলেজে যৌনতার সাধারণ শিক্ষাকে অশ্লীল বলে দাবি করে আমাদের পুরুষদের পর্ন থেকে যৌনতা বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞান আহরণের বিষয়টিকে, বাড়ির কাজের মেয়ে, কিংবা বাড়ির কিশোরীর অপ্রস্তুত এবং অনিচ্ছুক শরীরে তাদের প্রাথমিক এক্সপেরিমেন্টের বিষয়টিকে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকবো, ধর্ষণ কখনোই বন্ধ হবে না!
প্রাচীণ শাস্ত্রকারেরা অন্তত কিছুটা হলেও সৎসাহস দেখিয়ে বলে গিয়েছিলেন, যে পুরুষকে সুখী করতে নারীকে একই সাথে মা, প্রেমিকা, ভগ্নি এবং এমনকি বিছানায় প্রয়োজন হলে ইন্দ্রপুরীর স্বর্গবেশ্যা রম্ভার ভূমিকাও নিতে হবে।
আর এখনকার পুরুষেরা নারীকে সেই সুযোগটিও দিতে প্রস্তুত নন। নিজের প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীটি বিছানায় স্বতঃস্ফূর্ত হলেই আঁতকে ওঠেন এই ভেবে, এই নারী নিশ্চয়ই অসংযমী এবং দুশ্চরিত্রা। অনেক পুরুষের সাথে না শুলে এ অভিজ্ঞতা তার হয় কী করে! তাই ঘরে একটি পূত -পবিত্র স্ত্রী থাকা অবশ্যই প্রয়োজন, যে কিনা বিছানায় কখনোই তৃপ্ত করতে পারবেনা, পারার অধিকারও তার নেই।
তাই বলে তো আর পুরুষ মানুষের বসে থাকলে চলবে না, তারও তো একটা সাধ আহ্লাদ আছে, সুতরাং চলুক ধর্ষণ! শিশু কিংবা নারীরা যেহেতু ঠিক সম্পূর্ণ মানুষ নয়, তাদের শরীরটিও মনুষ্যশরীর নয়, তাদের মতামতের বালাই নেই কোন, সুতরাং তাদের ওপর একটু আধটু এক্সপেরিমেন্ট চলতেই পারে, কি বলেন!
যে সমাজ নারীকে ব্যক্তির মর্যাদা দিতে শেখেনি, যে সমাজ এখনো বিশ্বাস করে যে নারীকে পচনশীল খাদ্যদ্রব্য কিংবা বড়জোর মূল্যবান অলংকারের মতো গোপনে লুকিয়ে রাখা প্রয়োজন, যে সমাজ আমাদের শেখায় নারী স্বাবলম্বী হতে অক্ষম, তাই তাকে রক্ষা করতে পুরুষ অভিভাবকের প্রয়োজন, সেই সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে যৌনতা কিংবা প্রেমের সম্পর্কে নারীরও যে একটা মতামত কিংবা সম্মতির প্রশ্ন থাকতে পারে সেই ভাবনা অবান্তর বৈকি!
একটা আপাদমস্তক ধর্ষকামী সমাজব্যবস্থায়, যেখানে ৯৯% পুরুষ এবং হয়তোবা অধিকাংশ নারীও নিজেকে ভোগ্যপণ্যের বেশি কিছু ভাবেনা, সেই সমাজের চিন্তাচেতনা এবং নৈতিকতার ধারণাকে মগজের গভীরে, অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধারণ করা অব্যাহত রেখে ধর্ষণের প্রতিরোধ চাওয়ার চাইতে হাস্যকর কিছু আছে কি?
সত্যি যদি সাহস এবং সদিচ্ছা থাকে, নিজেদের জীবনে এবং পরিবারে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাগুলোতে ভাবনার উত্তরণ ঘটাই চলুন। জেন্ডার আইডেন্টিটি নির্বিশেষে ব্যক্তিকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখি, তার মতামতকে সম্মান করতে শিখি। দেখবেন বদ্ধ জলে পাঁক হয়ে জমে থাকা আবর্জনার মতো এইসব বিকৃত, ধর্ষকামী মানসিকতাও খোলা জলের স্রোতে কোথায় ভেসে গেছে। নারীকে (এবং পুরুষকেও) মানুষ হিসেবে গণ্য করলেই চলবে, তাদেরকে রক্ষা করার জন্যে ব্যাকুল হবার প্রয়োজন থাকবেনা একটুও।