পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে নারী নির্যাতন চলবেই

ফাতেমা জোহরা:

বুঝতে পারার সময় থেকে দেখে আসছি নারীদের ঘানি টানা চরিত্রে।ব্যতিক্রম দুইজন নারী, সে আমার মা আর বড় নানু
(সময়ের আগেই এসেছিলেন তাঁরা এই ধরায়)। শহরের অভিজাত এক পরিবারে ( নানুবাড়ি) জন্ম, কিছুটা বড় হওয়া। বিরাট একান্নবর্তী পরিবার, পাঁচ ভাইয়ের বিশাল এক ব্যাটেলিয়ন, সদস্যসংখ্যা প্রায় ৬০/৭০ জন।মেয়েদের সংখ্যাধিক্য থাকলে অধিকার ছিল সংরক্ষিত। পাঁচ নানুর ব্যস্তসমস্ত রসুইঘরে দিনমান কাটানো।

ভালো লাগছে না, একটু শুয়ে থাকি এমন দৃশ্য কখনো চোখে পড়ে নি। তবে শৌখিন ও সমাজে নতুন ধারা চালু করতে এই পরিবারে বছরে একবার হজ্জ্ব করা, শীতকালীন কক্সবাজার আর ইন্ডিয়া, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ট্যুর প্রচলন শুরু হয়েছে।সে তো কেবল স্ট্যাটাস বাড়ার জন্য।আজ থেকে ৩০/৩৫ বছর আগের কথা।

গ্রামীণ জীবনে ও তাই।পাড়ার বউ- শাশুড়িদের দিন শুরু হতো রাতের শেষ প্রহরে ( বিশেষ করে ধানের ময়)। পড়তাম ভোররাতে উঠে, কুলা থাপড়ানো আর গরুকে তাগাদা দেওয়ার হেই হেই শব্দ শুনে যেতাম অভ্যস্ততায়। সারাদিন কাজ, রাত অব্দি কাজ, বিরতি নেই কৃষাণি জীবনে।কখনো মনে হয় নি তারা কেউ আলাদা জন।সবাই মিলে একটাই চরিত্র, একটাই কাহিনী।যা যুগ যুগ ধরে আমাদের বোধে ঢুকে গেছে।

ভোরে আরবী পড়তে মসজিদে যাওয়ার আগে সব ছেলেমেয়েরা যখন মুখ ধুতে পুকুর ঘাটে যেতেম, দেখতাম চাচী আর ভাবীদের পুকুরে সন্তরনরত বা গল্পগুজব মত্ত। প্রায় প্রতিদিনের এই দৃশ্য শিশুমনে কোন প্রশ্ন তোলেনি অভ্যস্ততায়। আজ ভাবি সারা দিনমান ধকলের পর রাতটাও একান্ত বিশ্রামের থাকতো না নারীদের আর বছর বছর সন্তান ধারণ। ক্লাস এইটে পড়ার সময় চাচীদের জোর করে বন্ধ্যাকরণ করিয়েছি সুস্থ থাকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য।

এই হলো বিবাহ পরবর্তী জীবন। এর আগের জীবন, তখন খুব একটা বুঝতাম না, শ্লীল -অশ্লীল , নীতি – নৈতিকতা খুব একটা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল না। একদিন চাচীদের কথা থেকে বুঝলাম, এমন একজনে বাচ্চা হবে। কীভাবে বাচ্চা হবে, তার তো বিয়েই হয়নি? প্রশ্নগুলো জট পাকিয়ে যেত কুলকিনারা না পেয়ে। দেখতাম গরীব ঘরের মেয়েদের উপর এক ধরনের অধিকারবোধ পাড়ার পুরুষদের। এখন বুঝি এই অধিকার বোধ কতটুকু ছিল। সে অধিকার যদি বাধাপ্রাপ্ত হয় তাকে কুলটা বলে সমাজচ্যুত করা হয়।

এই যে আমরা মা, চাচী, স্ত্রী, বোন ও মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট চরিত্রের মধ্য দিয়ে বিচার করি, তারা মেয়েমানুষ। এটা আমাদের আজন্ম সংস্কারের মতো রক্তের মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে গেছে, সে পুরুষ কী নারীর মধ্যেও। এই হলো আমাদের আবহমান ব্যক্তিমানস। যতোদিন নারী স্বতন্ত্র একজন ব্যক্তিসত্তা খুঁজে না পাবে, তার স্বাভাবিক চাহিদাগুলো অর্জিত না হবে ততদিন সে আক্রান্ত হয়ে যাবে। যতোদিন পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গির বদল না হবে, ততদিন এইভাবে বিচারহীনতা নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে।

শেয়ার করুন: