তানিয়া কামরুন নাহার:
বন্ধুর মাধ্যমে আরেকজনের সাথে মেয়েটির পরিচয় ও বন্ধুত্ব। তারপর একদিন সেই পুরোনো ও নতুন বন্ধুর অনুরোধে জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়া। সাথে মেয়েটির আরেক বান্ধবী। তারপরের ঘটনা এতক্ষণে আপনারা সবাই জেনে গেছেন। পুরোনো বন্ধুটি মেয়ে দুটিকে নতুন বন্ধুদের কাছে রেখে চলে যায়। তারপর জন্মদিনের সেই পার্টিতে দুই বান্ধবীই নতুন দুই বন্ধুর (??) দ্বারা ধর্ষিত হয়। শুধু তা-ই নয়, সেই ধর্ষণ দৃশ্যের ভিডিও করে রাখা হয় এবং মেয়ে দুটিকে এক মাস ধরে নানা রকম ভয় দেখিয়ে গেছে।
অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তান বলে এমন অপরাধ করেও ধর্ষকেরা পার পেয়ে যেতে পারে বলে অনেকেরই আশংকা। কিছুদিন আগে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত আলোচিত ভারতীয় সিনেমা ‘পিংক’এর বাস্তব ভার্সন-ই যেন এই ঘটনাটি। কিন্তু বাস্তবতা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। এই ঘটনা আমাদের বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি করিয়ে দেয়।
–নতুনদের নৈতিকতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে?
— প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তান বলে ঘটনা কি ধামাচাপা পড়ে যাবে?
–একটি মেয়ে কি তার বন্ধুকেও বিশ্বাস করতে পারবে না?
এ কেমন পরিবেশ আমরা তৈরি করলাম যে, একটি মেয়ে তার বন্ধুকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! কিন্তু এতো অবিশ্বাস বুকে নিয়ে কি চলা যায়? শ্বাস নেওয়াই কষ্টকর হয়ে উঠবে।
নিজের ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। অনেক পরিচিত পুরুষদেরকে আমার ধারে-কাছে ঘেঁষতে দিই না, এড়িয়ে চলি। এটা করতে হয়, কেননা তাদের উপর আমার আস্থা নেই, তাদের কাছে গিয়ে নিজেকে নিরাপদ বোধ করি না, কিংবা আমি জানি নারী সম্পর্কে তাদের ধারণা অত্যন্ত নিম্ন স্তরের।
আবার ট্রাভেলিং করতে গিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সাথে অচেনা পথে একাই চলে গেছি নির্ভয়ে। এমনও হয়েছে, গ্রুপের কাউকে চিনি না, আমি একমাত্র মেয়ে। এমনও হয়, একই নেটওয়ার্কে থাকার ফলে একজনের মিউচুয়াল থেকে আরেকজনের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই আমরা ট্রাভেলিং–এ চলে যাই। তাই বলে ধান্ধাবাজেরাও যে মাঝেমাঝে মেয়েদের সাথে খাতির জমিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করে না, এটা হলফ করে বলা যাবে না।
মেয়েদের ব্যাপারেও অনেকের মানসিকতা খুব একটা উন্নত থাকে না। এসব ক্ষেত্রে আমরা বন্ধুদেরকে ঐসব বিপদজনক ব্যক্তি সম্পর্কে আগাম সতর্ক করে দিতে পারি। হয়ত আপনার একটু সতর্কতা কাউকে বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। এবং ঐ ধরনের ব্যক্তিদের বয়কট (অভিযোগের গুরুত্ব ও প্রমাণ সাপেক্ষে) করাও সংগত। কারণ এখানে মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত।
মেয়েরা মাত্রই ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে, একজন মেয়েকে দেখে আরেকজন মেয়েও উৎসাহিত হয়ে বেড়াতে যেতে আগ্রহী হয়। এরকম অবস্থায় একটি মেয়েরও যেন নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে।
শুধু ট্রাভেলিং এর কথাই বা কেন বলছি, সব অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এলাকা, গণপরিবহন, পথেঘাটে, বাজারে, শপিং মলে, মাঠে ময়দানে, উৎসবে, ধর্মীয় উপাসনালয়, এমন কি নিজের ঘরেও, সবখানে পরিচিত অপরিচিত সব পুরুষের প্রতিই যেন নারীরা বিশ্বাস রেখে চলতে পারে। পুরুষদের সাথে চলতে গিয়ে একটি নারীকে যদি নিরাপত্তার জন্য গোপনে ধারালো অস্ত্র বা পিপার স্প্রে নিয়ে চলতে হয়, তবে তা পুরুষদের জন্য নিশ্চয়ই অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার।
একজন নারীকে কেন পুরুষের চোখের সামনে সাধারণ পোশাকে এলে অস্বস্তিতে ভুগতে হবে? নিজেকে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে তারপর যদি একজন নারীকে পুরুষের সামনে আসতে হয়, তাহলে এতে পুরুষ চরিত্রের শুধু লাম্পট্যই প্রকাশ পায়। এটা কি পুরুষদের জন্য অপমানজনক নয়? পুরুষদের ভেবে দেখা উচিত, পুরুষের প্রতি নারীর অবিশ্বাস পুরুষদের জন্য অসম্মানজনক।
পুরুষরা নিশ্চয়ই এভাবে নারীদের কাছে অপমানিত, অসম্মানিত হতে চান না! আর তা না চাইলে, নারীর বিশ্বাসের স্থানটি পুরুষকেই অর্জন করে নিতে হবে। কেননা, শেষ পর্যন্ত নারীরা পুরুষদের বিশ্বাসই করতে চায়।