নারীদের মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে হবে

লীনা পারভিন:

আজকাল বড্ড অবসাদ্গ্রস্থ লাগে নিজেকে। মনে হয় কোনকিছুরই যেন কোনো মূল্য নেই। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকের দেয়ালে পড়ছি একই ঘটনা, একই তার চরিত্র, তার যেন কোন পরিবর্তন নেই, নেই কোন প্রতিকার। কত কথাই তো হচ্ছে প্রতিদিন। প্রতিদিন একটি করে ঘটনার বর্ণনা পড়ি শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠে আর অক্ষম আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি কি-বোর্ডের উপর। মনে হয় কি-বোর্ডের একেকটা কি যেন একেকজন নির্যাতনকারী।

যতটা কঠিন হওয়া যায় ততটাই তৃপ্তি পাই, মনে হয় এইতো কিছু একটা শাস্তি তো দিতে পারলাম। তারপর? সেইসব লেখা পড়ে আর কয়জন? হয়তো পড়ে অনেকে, কিন্তু গ্রহণ করে কয়জন? হয়তো করে বা করে না। মনোজগতে কী কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে আমার লেখা? জানি না এর উত্তর কী পাবো? পরক্ষণেই আবার ভাবি, যার যা অস্ত্র তাকে তো সেটা নিয়েই লড়াইটা চালু রাখতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে এই আমরাই আবার মাঠে নামবো, তার আগে একটা ক্ষেত্র তো প্রস্তুত করতে হবে। সেটাও কী একটা দায়িত্ব নয়?

বলছিলাম, অতি পরিচিত একটা আলোচ্য বিষয়, নারী নির্যাতনের কথা। এ যেন একপ্রকার ডালভাতের পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। নারীর প্রতি নির্যাতন এখন আর কোন নির্দিষ্ট ডাইমেনশনে থেমে নেই। চলছে নানামুখী অত্যাচার, নানা ঢঙে, নানা ভাবে। সমাজের উঁচু তলার বাসিন্দা থেকে শুরু করে নীচু তলা পর্যন্ত কেউ কী বাদ যাচ্ছে এই নির্যাতন থেকে? না, কেউ বাকি নেই। কেউ বা শারীরিক, কেউ মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

আমরা প্রতিদিন উচ্চকিত থাকি নারীর প্রতি বাহ্যিকভাবে প্রকাশিত বা দৃশ্যমান নির্যাতনের বিষয় নিয়ে। ধর্ষণ, হত্যা, জখম নিয়েই কথা বলি আমরা মূলত। কিন্তু আরেকটি নীরব ঘাতকের নাম হচ্ছে নারীর প্রতি গৃহ নির্যাতন বা যাকে পারিবারিক নির্যাতন নামে একটি পোশাকি নাম দেয়া হয়েছে। সে নির্যাতনের কত অংশ আমাদের সামনে আসে, সেটা গবেষণার বিষয়। প্রতিদিন নারীরা তাদের ঘরে যে পরিমাণ মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছে, সেটা নিয়ে কথা বলি খুব কম। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে আমরা ধরেই নেই গৃহের অভ্যন্তরে যা ঘটে, সেটা নিতান্তই তাদের পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিষয়। সেটা নিয়ে কথা বলাটা আমাদের জন্য উচিত অনুচিতের বিষয়। তাই অনেকের অনেক বিষয় জানলেও আমরা চুপ করে থাকি যতক্ষণ না বিষয়টা বোমার মতো ফেটে উঠে।

এরকমই দুটি ঘটনার উদাহরণ তো আমাদের সামনেই আছে। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক এবং দুজনেই তাদের জীবনসঙ্গীর দ্বারা নির্যাতিত। একজন নাজনীন আখতার তন্বী, আরেকজন সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া মাছরাঙ্গা টিভির প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত মুখ ইবতিসাম নাসিম মৌ। মৌ এর ঘটনা প্রথম আমি শুনি নাহিদ আপার (নাহিদ সুলতানা) ফোন পেয়ে গত সোমবারে। তখন মৌ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। উত্তেজিত নাহিদ আপার কন্ঠে তখন দারুণ প্রতিবাদের ঝড়। নাহিদ আপা উৎকন্ঠিত কন্ঠে আমাকে বলছে,  “লীনা, তুমি এইসব নিয়ে লেখো। লিখতে হবে। বেশী বেশী বলতে হবে।“

উনাকে শান্ত করেই বিষয়টা শুনতে চাইলাম। ঘটনা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মৌ এর দারুণ মায়াবী ও আকর্ষণীয় চেহারাটা। তিন-তিনটি সন্তানের জননী সে। ঠিক তেমনি তিনজন সন্তানেরই জনক সেই অত্যাচারী স্বামীটি। যিনি আবার আইএফআইসি ব্যাংকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। শুনলাম মৌ এর সাথে এধরনের অত্যাচার সে আগেও করেছে। একবার তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও আবার তারা একসাথে হয়েছে এবং তারপরেই আরও দুটি সন্তান এসেছে তাদের কোলজুড়ে।

ধরে নিতেই পারি অবশ্যই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের কোনো ঘাটতি ছিলো না, না হয় কেমন করে দুটি সন্তান এলো? ঘটনার কোনো জোরালো ভিত্তি পাই না যখন শুনি মৌ সবসময়ই এই গৃহ নির্যাতনের শিকার এবং এটা নতুন কিছু নয়। এই বিষয়ে মৌ এর প্রতিও আমার রাগ বা ক্ষোভ আছে তবে সেটা পরে আসছি।

মৌ একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক, একজন সচেতন নারী হয়েও কেন এতোদিন মুখ বন্ধ করে রেখেছিলো? অনেকেই কর্কশ গলায় আমরা এই প্রশ্নটি করে ফেলবো এবং সেখানে দোষের কিছু নাই হয়তো, কিন্তু মাতৃত্বের দুর্বলতা একজন মায়ের সবচেয়ে বড় শিকল তার স্বাধীনতাকে চর্চার ক্ষেত্রে। একজন বাবা হয়তো বা অনেক সহজেই অনেক কিছু করে ফেলতে পারেন, নাহলে মৌ এর স্বামী সাইফুল কেমন করে সন্তানের সামনে তাদের মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারে? কেমন করে তারই জন্ম দেয়া তিনটি সন্তানের কথা চিন্তা না করে একজন স্ত্রীকে অপমানের চূড়ান্তে নিয়ে যেতে পারে? কই মৌ’তো পারলো না!!

এখানেই হয়তো আমাদের নারীদেরকে আবারও ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমি একজন মা, একজন স্ত্রী, একজন প্রফেশনাল ব্যক্তি যেখানে আমার ব্যক্তি ইমেইজ আছে, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আছে, তবে অবশ্যই তার সবকিছুকে ছাপিয়ে আমার নিজের অস্তিত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে আগে। যেকোনো নির্যাতনের প্রথমেই তাকে মোকাবিলা করতে হবে এই একটি জায়গাকে মাথায় রেখে যে, আমি একজন ব্যক্তি যার একটি নিজস্ব জগত আছে, নিজস্ব মতামত আছে। আমার ব্যক্তিত্বকে যে পুরুষ স্বীকার করে না, তার কাছে সম্মান পাওয়ার আশা করাটা বোকামী। তাই প্রথমেই সমাজ বা পরিবারে আমার নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করাটা জরুরি।

একজন পুরুষ সে বৈবাহিক বা প্রেমের সূত্রেই আমার সাথে সম্পর্কিত বলেই আমার উপর তার মত চাপিয়ে দেয়া বা তার খেয়ালখুশি চাপিয়ে দেয়ার অধিকার পেয়ে যায়নি। একজন মা হিসাবে অবশ্যই সন্তানের দায়িত্ব আমার কাছে এক নম্বর, কিন্তু সন্তানের জন্ম দেয়ার দায় কেবল আমার একার নয়, তাহলে কেন সারাজীবন আমি এই দায় বা দায়িত্ব একাই বহন করার নিয়ত করে নিজেকে শেষ করে দিব?

মৌ এর উপর রাগ আমার এই জায়গাটাতেই যে সে যখন প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলো তার স্বামী তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল বা সহমর্মী নয়, তাহলে আরো দুটি সন্তান জন্ম দেবার মত ঝুঁকিতে কেন গেল? তার উচিত ছিলো প্রথম দিনেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা। আমরা মৌ’রা যদি সমাজে উদাহরণ তৈরি করতে না পারি, তাহলে সমাজের আনাচে-কানাচে হাজারও মৌ’দের জন্য কে কাজ করবে? শিক্ষিত, সচেতন নারীদের কাছেই আছে গ্রামের নির্যাতিত খোদেজা, আমেনাদের সমাধান।

তাই আমার সহযাত্রীদের কাছে অনুরোধ, নিজেকে অন্যের হাতে সমর্পণ করার আগে ভেবে নিতে হবে সে হাতটি তোমার উপযুক্ত কিনা! যখনই বুঝতে পারবে সামান্যতম অমর্যাদার চিহ্ন সেখানে উপস্থিত, ঠিক সেই মুহূর্তেই নিজের সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিতে হবে স্বার্থপরের মতো।

গৃহ নির্যাতন এক মহাব্যাধির নাম। শারীরিক নির্যাতন দেখা যায়, কিন্তু মানসিক নির্যাতন নামক ঘূণপোকা একমাত্র সেই কাঠই টের পায় যার ভিতরে সেটি জায়গা করে নেয়। এসব ঘটনা আবারো প্রমাণ করে দেয়, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তিই একমাত্র মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে না, দরকার মানসিক দিক দিয়েও নিজেকে মুক্ত করা। মানসিক দাসত্ববোধ নিয়ে যত টাকা পয়সাই উপার্জন করি আর যতই খ্যাতি অর্জন করি, সব বৃথা হয়ে যাবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.