বিচারহীনতার নৃশংস সমাজব্যবস্থার বিবেকে সজোরে লাথি

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:

প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রভাবশালী জমিদার ঠাকুর অবোধ নারায়ণ সিং। প্রতাপশালী জমিদার আর তার অত্যাচারী দুই পুত্রের তাণ্ডবে গ্রামবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। হতদরিদ্র রুদ্র সেই জমিদার পরিবারের অনুগত ভৃত্য, বহু অন্যায়ের নীরব সাক্ষী।

মাথা নত করে জমিদার পুত্রদেরকে সেবা করে যাওয়া রুদ্র বুঝতে পারেনি যে তার জীবনে দারিদ্র্যকে ছাপিয়েও আরো ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছিলো। বুঝতে পারলো যেদিন তার নয় বছরের শিশুকন্যা দুর্গাকে ধর্ষিত ও মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করতে হলো। স্নেহশীল, দরিদ্র পিতার জানতে বাকি রইলোনা যে, এই নির্মম পৈশাচিক ঘটনার হোতা জমিদারের অপদার্থ, বখাটে পুত্রদ্বয় – বাচ্চু আর ভোলা ছাড়া কেউ নয়।
বাকরুদ্ধ মা আর অসহায় পিতা তার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকা কন্যাকে বুকে নিয়ে ছুটে যায় হাসপাতালে। এতোদিনের শোষণ – বঞ্চনা সয়ে যাওয়া রুদ্র এবার পিতার ভূমিকায় ঘুরে দাঁড়ায়। ঠাকুরসিং এর পুত্রদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নামে সে। পুলিশ ধর্ষণকারীদের আটক করে।
ঠাকুরসিংও রুদ্রর মতো সামান্য এক দাসের কাছে হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। শুরু হয় টাকা আর ক্ষমতার সাথে সহায়সম্বলহীন রুদ্র এবং তার পরিবারের লড়াই। মেয়েকে সারিয়ে তোলার জন্য যে ডাক্তারকে দেবতুল্য আসনে তারা বসিয়েছিলো, সেই ডাক্তারবাবুও একদিন মোটা অংকের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেল! 
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া, নয় বছরের ফুটফুটে সেই ধর্ষিত শিশুকন্যার  পিতা রুদ্র ভুলে যায় তার দাসত্বের শেকলে আবদ্ধ অতীত। পিতৃসত্তায় জ্বলতে থাকে ক্ষোভের আগুন। যতদূর মনে পড়ে, অবশেষে শত বাধা পেরিয়ে সে প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়ে।
এতোক্ষণ বলছিলাম সঞ্জয় দত্ত, নন্দিতা দাশ অভিনীত পিতাহ্ চলচ্চিত্রের গল্প। সঞ্জয় মাঞ্জরেকার পরিচালিত এই মর্মস্পর্শী কাহিনীর চলচ্চিত্রটি অনেক বছর আগে দেখা। ধর্ষণের শিকার মাসুম শিশুকন্যার পিতার ভূমিকায় সঞ্জয় দত্তর বাস্তবসম্মত অভিনয় চোখে জল এনে দিয়েছিলো সেসময়।
আজ বহুবছর পর ছবির দৃশ্যগুলো চোখে ভাসতে লাগলো। 
গত কয়েকদিন ধরে একটি খবরের শিরোনামে দৃষ্টিটা যেন আটকে আছে। ” ধর্ষণের বিচার না পেয়ে আট বছরের কন্যাকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে পিতার আত্মহত্যা”।
এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরের শ্রীপুরে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হযরত আলী ও হালিমা বেগম দম্পতি তাদের নিঃসন্তান জীবনে আট বছর আগে এই শিশুটিকে সন্তান হিসেবে বুকে তুলে নিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন আয়েশা আক্তার। গ্রামের বখাটে যুবক ফারুকের বিকৃত দৃষ্টির খপ্পর থেকে রেহাই পায়না বাবা – মায়ের আদরে মানুষ হওয়া নিষ্পাপ আয়েশা। লম্পট ফারুক হোসেন ক্রমাগত উত্যক্ত করতে থাকে মাত্র প্রথম শ্রেণিতে পড়া বাচ্চাটিকে। ধর্ষণ চেষ্টা চলে একাধিকবার। একদিন জোর করে সাইকেলে তুলতে গেলে আঘাতপ্রাপ্ত হয় আয়েশা। পায়ে পচন ধরে সেই আঘাত থেকে। স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে  ঘুরেও হতদরিদ্র পিতা হযরত আলী এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচারের সম্ভাবনা দেখে না। ইউপি সদস্য আবুল হোসেন বিচারের পরিবর্তে ঘটনা ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়। বরং গ্রামে আরো দশটা লোকের কাছে, তথাকথিত সমাজের কাছে হযরত আলী ও তার পরিবারকে হেনস্থা হতে হয়। ধর্ষক ফারুক ততোধিক দম্ভের সাথে গ্রাম দাপিয়ে বেড়ায়, হযরত আলীর গরু চুরিসহ নানান অত্যাচার ও হুমকি – ধামকি দিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলে পরিবারটিকে। 
অপমান ও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শেষমেশ অপমানের চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করলো হতভাগ্য এই পিতা। ভোরবেলা মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে রেলস্টেশনে যান হযরত আলী। ট্রেন আসতে দেখে আট বছর বয়সী বুকের মানিককে ছুড়ে দিলেন চলন্ত ট্রেনের নিচে। এরপর নিজেও ঝাঁপ দিলেন।
আহা ! আয়েশা আক্তার ! বাবার সাথে বেড়াতে যাবে বলে লাল রঙের ফুলছাপা জামা পরেছিলো সে। দরকার ছিলো না, যে জামাটাই পরতো রক্তে লাল হয়ে যেতো সেদিন। 
শুনলাম প্রশাসনের কোনো এক ব্যক্তি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়নি। আমার প্রশ্ন, তবে কী মেয়েটি ধর্ষিত হোক, তারপর ব্যবস্থা নেয়া হবে – সেই অপেক্ষাতেই আপনারা ছিলেন?  একাধিকবার ধর্ষণের চেষ্টা কী কোনো অপরাধের আওতায় পড়েনা ? 
আয়েশা ধর্ষিত হয়েছিল কী হয়নি তা আমি নিশ্চিত নই। তবে এটুকু নিশ্চিত যে একজন পিতা যখন সন্তানকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, ধর্ষকামী ব্যক্তির শাস্তি দাবি যখন বারবার তিরস্কৃত হয়  –  সেই অপমানও উপর্যুপরি ধর্ষণের শামিল। আট বছর বয়সী শিশুকন্যার বেদনার্ত চোখে চোখ মেলানোর মতো মানসিক শক্তি বা সাহসটুকুও বোধ করি অবশিষ্ট ছিলোনা হযরত আলীর।
” পিতাহ্ ” ছবির পিতা রুদ্রের মতো প্রতিবাদে জ্বলে উঠলেও শেষপর্যন্ত বাস্তবের পিতা হযরত আলীর পক্ষে প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব হয়না । পিতা হয়ে যখন কন্যার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো, ন্যায় বিচার আদায়ে ব্যর্থ হলো তখন হয়তো এ জীবন বয়ে বেড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।  
কন্যাসহ আত্মাহুতি দিয়ে বিচারহীনতার এই নৃশংস সমাজব্যবস্থার বিবেকে সজোরে লাথি দিয়ে গেল হযরত আলী। সেইসাথে পিতা – কন্যার এই করুণ পরিণতি বহু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো তথাকথিত সমাজপতিদের।   আমাদের শিশুদের জীবন বিপন্ন করে অপরাধীদের আশ্রয় – প্রশ্রয় দেয়া লোকগুলো কীভাবে প্রশাসনে জায়গা পায় ?
হৃদয়বিদারক এই ঘটনা সভ্যসমাজের সব অর্জনকে যেন এক শতাব্দী পিছিয়ে দিয়ে গেল। তারপরও কী জাগ্রত হবে আমাদের বিবেক?
শেয়ার করুন: