ঝুমকি বসু:
মেয়েটি প্রতিদিন সকালে নাস্তা বানায়। দুপুরের খাবার রান্না করে। থালা-বাসন মেজে, কাপড় ধুয়ে, ঘর গোছায়। বিকেল-বিকেল শেষ করে ফেলে রাতের রান্না। তারপর সন্ধ্যার নাস্তা রেডি রাখে। কেটলীতে কফির জন্য গরম পানি বসিয়ে ওয়েট করতে থাকে স্বামীর ঘরে ফেরার। খুব ইচ্ছে করে স্বামী অফিস থেকে ফিরলে ব্যালকনিতে বসে দুজন মিলে কফি খাবে।
প্রতিদিনের মতো স্বামী ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়। মেয়েটি কফি বানিয়ে আনে। স্বামী ততক্ষণে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। মেয়েটি স্বামীর সামনে কফির কাপ রেখে ব্যালকনিতে চলে যায় একা। চাপা কষ্ট নিয়ে কফি শেষ করে। স্বামীটি তারিয়ে তারিয়ে কফি উপভোগ করে আর ফেসবুকে চ্যাটিং করে।
কিংবা সেই মেয়েটির কথাই বলি। ভোর হতেই ঘুম থেকে উঠে সারাদিনের রান্না শেষ করে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যায়। এসে বাচ্চাকে পড়ানো, রাতের রান্না। দিনশেষে বিছানায় ক্লান্তির ঘুম। ঘুমানোর আগে খুব ইচ্ছে করে স্বামীর সঙ্গে একটু মনের কথা বলবে। কিন্তু স্বামী তখন ব্যস্ত তার বন্ধুদের সঙ্গে টুইটারে। যা চলবে মধ্যরাত, আর উইক এন্ডে সারারাতব্যাপী।
স্বামী সারাদিন অফিসে ব্যস্ত সময় কাটায়। মেয়েটিও সারাদিন ব্যস্ত কখনো অফিসে, কখনো বা বাসায়। যতই মেয়েদের নিজস্ব জগত থাকুক। তারপরও সব মেয়েই চায় স্বামী অফিস থেকে ফেরার পর তার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে। সারাদিনের কতো কথা জমানো থাকে সেগুলো শেয়ার করার সময়ওতো শুধু এটুকুই। ফেরার পর যদি তিনি স্ত্রীর চাইতে ফেসবুক-টুইটারেই বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করেন তাহলে তার স্ত্রীর কেমন লাগতে পারে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আজকাল বড্ড বেশি বেডরুমে প্রবেশ করে ফেলেছে। কারো বেডরুমে প্রবেশের আগে অনুমতি নেবার প্রয়োজন হয় কিন্তু এক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার আবাধ-স্বাধীন। তাই সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে গিয়ে আজ আমরা হারাতে বসেছি ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সবার সব কথা শুনতে গিয়ে, জানতে পারছি না কাছে থাকা মানুষটির একান্ত ভাবনা। এভাবেই আমাদের দিন চলে যায়। আর ফিকে হতে থাকে সম্পর্কগুলো । কিছুদিন আগেও যখন ফেসবুক-টুইটার ছিল না, তখনো কি মানুষের সময় কাটে নি? এটা কি শুধুই সময় কাটানো? যা আপন মানুষের সঙ্গের থেকেও বেশি প্রিয়?
আমি শুধু এইসব স্বামীদেরকে দোষ দেবো না, দোষ চ্যাটিং এর উল্টোদিকে থাকা মানুষটিরও কম নয়। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় এইসব পুরুষের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ম্যারিড, এমনকি সুখী দাম্পত্যের ছবিও জ্বলজ্বল করছে। এটা দেখার পরও যার বা যাদের সঙ্গে তিনি ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছেন, যদি সেই নারীটি বা নারীসকল লোকটির ভালোই চাইতো, একবারও কি তিনি বা তারা বলেছেন, ‘আপনি অফিস থেকে ফেরার পর আমার সঙ্গে কেন কথা বলছেন? আপনার সঙ্গীকে সময় দিন।’
বলেছেন এ কথা? যদি না বলে থাকেন, তাহলে হয় তিনি বা তারা আপনার ভালো চান না, চান না আপনার ফ্যামিলি লাইফ মধুর হোক নয়তো মনে মনে খুশিই হচ্ছেন এটা ভেবে যে আপনার স্ত্রীর জন্য বরাদ্দকৃত সময়টাতে তিনি বা তারা ভাগ বসাতে পেরেছেন।
আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে নারীর দুঃখ-কষ্টের জন্য কখনো শুধুমাত্র পুরুষকে দায়ী করি না। একজন নারীকে পুরুষ যতটা মানসিক কষ্ট দেয়, তার থেকে বেশি কষ্ট দেয় আরেকজন নারীই। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। যে নারীটি একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে অফিস থেকে ফেরার পর সময় কাটাচ্ছেন, সারারাত জেগে চ্যাটিং করছেন, তার ভেতর কি কোন অপরাধবোধই কাজ করে না? একবারও কি সে ভাবে না, তার স্বামী যদি তার সঙ্গে এমন করতো, তার কেমন লাগতো? কেন নারী হয়েই আমরা কেউ কেউ এমন সর্বনাশের খেলায় মেতে উঠি। কখনো কখনো এই সর্বনাশের খেলায় আমরা ভেঙ্গে ফেলি আর একটা মেয়ের সংসার। আবার তাতে মনে মনে খুশিও হই।
এটা আসলে অসুস্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নারী হয়ে এমন সর্বনাশের খেলায় যেন আমরা কোনো পুরুষকে আর ডেকে না আনি। এমনকি কোনো বিবাহিত পুরুষ স্বেচ্ছায় এমন খেলা খেলতে চাইলেও আমরা যেন সে ফাঁদে পা না দিই। তাকে এড়িয়ে চলি।
চলুন, আজ থেকে শপথ করি, আমরা নারী। আমাদের জন্য আর ভাঙবে না অন্য কোনো নারীর সংসার।