ধর্মীয় গোঁড়ামি কী করে বদলে দিচ্ছে সব!

রোকসানা ইয়াসমিন:
১. আমি যে এলাকায় থাকি গত পনেরো বছর ধরে ধীরে ধীরে এখানের মানুষগুলোর চেহারা পালটে যাচ্ছে। কারো বাড়িতে আমার যাওয়া হয় না। শাড়ি গয়না আর অন্যের আড়ালে তাদের বদগীতি গাওয়া বা শোনা আমার পছন্দ নয়। আমি পারি না। নিজের ঘরেই সময় কাটাতে ভালো লাগে। মানুষ বদলে যাচ্ছে দেখি। মানসিকতা বদলে যাচ্ছে, কাপড় চোপড় বদলে যাচ্ছে। কিছু মানুষের চেহারা আর দেখিনা, শুধু চোখ দেখি। দেখি এলিভেটরে, পথে।
ভয় হয়। ভয় হয়েছিল সেদিনও যেদিন দেখেছিলাম আমার পড়শি একজন প্যালেস্টিনিয়ান কলিগের খুব হ্যান্ডসাম শান্তশিষ্ট বিশ বছরের ছেলে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে এসে কাপড় চোপড় চেহারা পালটে ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করেছে। কিছু মাস পরে শুনি নিউ ইয়র্কে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিল। এখন জেলে। কাল সন্ধ্যেয় বাইরে যাবো, তৈরি হচ্ছি, এ সময় দরোজায় কলিং বেলের শব্দ। খুলে দেখি মসজিদ থেকে এসেছেন, কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা ইসলামের দাওয়াত দিতে। এরা মুসলমানদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে প্রতি সপ্তাহেই নিয়ম করে সকলের বাড়ি যান। কিছু বছর ধরে মহিলারাও আসছেন। যতবারই আসেন ওনারা, আমার হাসব্যান্ডকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার কথা বলেন, নানা রকম মাহফিলের দিন তারিখ দিয়ে যান।
আরও বলে যান যে, আজান শোনার পর যে নামায আদায় করতে না যায়, তার কান দিয়ে শত শত বিষাক্ত আগুনের সাপ বিচ্ছু ঢুকে তাকে দংশন করবে অনন্তকাল। এই আযাব থেকে যেন আমরা আমাদের নিজেদের রক্ষা করি। আমার হাসব্যান্ড ঈদের নামাজ পড়তেই কেবল মসজিদে যান, কিন্তু ওদের সে কথা বলতে পারেন না, বলেন, সময় পেলে যাবেন মসজিদে।পুরুষরা বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলেন। মহিলারা ঘরের ভেতর এসে বসেন। আমাকে হেদায়েত করেন। যাবার আগে বলে যান, আমি যেন বিধর্মী পোষাক বর্জন করি, আর কপালে বিধর্মীদের মতো লাল টিপটি আর না পরি।
আমার ইচ্ছেমতো আমি ধর্মকর্ম করবো। আমার ইচ্ছেমতো আমি সাজগোজ করবো, নিজের বিশ্বাস থেকে, জ্ঞান থেকে, নিজে জেনে বুঝে যতটুকু নেবার আমি ধর্ম নেবো। সম্পূর্ণই আমার স্বাধীনতা। অথচ কীভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মের নামে ভুল বিশ্বাসগুলো, গোঁড়ামিগুলো জোর করে ধর্মভীরু সাধারণ সরল মানুষদের মস্তিষ্কে চাপিয়ে দিতে সার্থক হয়েছে ওরা!
পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয়া সানজিদা খাতুন বলেছিলেন, আমাদেরও পথে নামতে হবে, বিভিন্ন ভাবে মানুষের মনে বোধে পৌঁছাতে হবে, গ্রামে শহরে শিক্ষামূলক নাটক গান কবিতা নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সত্যবুদ্ধি, সত্যপথ বোঝাতে হবে, বোঝাতে হবে ধর্মীয় গোঁড়ামির কুফল। অনেক দেরী হয়ে গেছে। আর দেরী করা আমাদের উচিত হবে না।
২. বাংলাদেশে একজন মহিলাকে জানতাম, তিনি শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী, নিজের চেষ্টায় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দাঁড় করিয়েছিলেন। দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে একা থাকতেন, তিনি একাই ওদের লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ওনার মা-বাবা- ভাইবোনেরাও ওদের পাশে থেকেছেন। মানসিকভাবে সাহস দিয়েছেন। আমি জানতাম ওনার হাসব্যান্ড মারা গেছেন।মৃত মানুষটি সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানবার ইচ্ছে কখনও হয়নি আমার।
কিছুদিন আগে জেনেছি ওনার হাসব্যান্ডকে উনি ডিভোর্স দিয়েছিলেন। ডিভোর্স দিয়েছিলেন কারণ সংসারে ওনার হাসব্যান্ডের মন ছিল না। একবার তবলিগ দলের সাথে মিলে পোশাক আশাক, চেহারা সুরত পালটে উধাও হয়ে গেলেন কোথাও। বছর বছর ওনার কোনো খোঁজ পায়নি কেউ। একদিন জানালেন, তিনি কুয়েতে আছেন। কী করছেন ওখানে? ইসলাম শিখছেন। জানালেন টাকা পয়সা পাঠাতে পারবেন না। ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে স্ত্রীকে তার মা-বাবার কাছে গিয়ে থাকতে বললেন। ওনার বাবা ভাই ঢাকায় বেশ প্রতিষ্ঠিত। চেনা ব্যক্তিত্ব। তিনি রাজি হননি মা-বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠতে।
খুব ভালো রেজাল্ট নিয়ে মাস্টার্স করেছিলেন, কিন্তু হাসব্যান্ড ওনাকে চাকরি করতে দিতেন না। বাচ্চা দুটোর দায়িত্ব যেহেতু তাকেই নিতে হবে, সম্পর্ক শেষ করে বেরিয়ে এলেন নিষেধাজ্ঞা থেকে। আত্মমর্যাদা নিয়ে নিজেই প্রতিষ্ঠিত হলেন। উনাকে দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসতো। বিজনেসের শুরুতে ড্রাইভার রাখারও ক্ষমতা ছিল না ওনার। ড্রাইভ করে নিজেই অর্ডার পৌঁছে দিতেন দোকানগুলোতে। কয়েক মাস আগে ওনার মেয়ে এসেছিল নিউ ইয়র্কে। পড়াশুনা করছে। বিয়ে হয়েছে। একটি ছেলে আছে।
আমার সাথে দেখা করতে চাইলো ওরা, গেলাম দেখা করতে, ওর খালার বাড়িতে। মাথায় বিশাল উঁচু করে হিজাব পরা একটি মেয়ে আমার কাছে এসে বসলো, পরিচয় দিল যে ওই সেই মেয়ে। কেমন আছি, মা কেমন আছেন জাতীয় ভালো-মন্দ কথা শেষ করতে করতে চোখ ভিজে গেল, বললো, আব্বা মারা গেছেন ছ’মাস হলো। আমি ভাবছি, আব্বা কোত্থেকে! আপা কি আবার বিয়ে করেছিলেন? যদি করেই থাকেন, ওনার জন্যে এমন করে কান্না করবার কথা তো নয়! কিছুই মেলাতে পারছিলাম না। আমার একটা বাজে না ভালো স্বভাব আমি জানি না, ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করতে পারি না।
আমাকে প্রশ্ন করতে হলো না, ওর একার কথা থেকেই অনেক কিছু জানা গেল। শেষে জানলাম, উনি কুয়েত থেকে দেশে ফিরেছিলেন, কিন্তু আপা কখনও ফিরে যাননি ওর আব্বার কাছে। ছেলেমেয়েদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। “আব্বা খুব ভালো মানুষ ছিলেন, দাওয়াতের কাজ করতেন।” আমি খুব সহজ কথা বুঝি, ওই কথার মানে আমার কাছে দাঁড়ালো, ওনার হয়তো কোন ডেকোরেশন স্টোর ছিল। বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে ডেকোরেশনের কাজ করে। জিজ্ঞেস করলামও তাই। বললো, “না, আব্বা ইসলামী দাওয়াতের কাজ করতেন।” এবং ওরও ইচ্ছে, ও ওর আব্বার পথ অনুসরণ করবে, ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেবে।
বাংলাদেশে ভালো একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করা মেয়ে কী প্ররোচনায় এমন একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পারে, আমার বোধগম্য হয় না, আমার ভয় হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে হলি আর্টিজান, আতিয়া মহল। ও একজন সাহসী মায়ের মেয়ে। তিনি যে শিক্ষা সন্তানদের দিয়েছেন, তিনি তাঁর মেয়ের ভবিষ্যৎ যেমন আশা করেছিলেন, সেই শিক্ষা, সেই আশা উপেক্ষা করে মেয়েটি কী করে দূরে সরে গেলো! এতো কষ্ট করে যে মা একার উপার্জনে ওদের লালন পালন করেছেন, বুকে আগলে রেখেছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন, সেই মায়ের প্রতি আজ ওর শ্রদ্ধা কতখানি নেমে এসেছে!
মেয়েটির ধারণা “আম্মা ভুল করেছিলেন আব্বাকে ডিভোর্স দিয়ে।” বিষণ্ণ মন নিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, বিয়ের পর থেকে যে মানুষ তার স্ত্রীকে নানা রকম অবহেলা করেছে, তার সন্তানদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পর্যন্ত নেয়নি, জীবনের বেশিরভাগ সময় ঘরের বাইরে কাটিয়েছে, স্ত্রীকে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করেনি বছরের পর বছর কোথায় আছে, সংসারের অর্থনৈতিক দায়িত্বও নেয়নি, নিজের ছেলেমেয়েদের তার ভালোবাসা আদর থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে, সেই মানুষটিই কী করে জীবনের শেষ কয়েকটি বছরে সেই সন্তানদের কাছে বাবার নাম, অধিকার নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়! আর কী এমন কথায় ও কাজে তাদের মা’র প্রতি অশ্রদ্ধা আনতে সক্ষম হয়! কী করে তাদের ভাবাতে পারে যে, এতো সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও ইসলামের দাওয়াতের কাজ যে করে, সে সকল ক্ষমার যোগ্য এবং তার আদর্শ অনুসরণীয়!
শেয়ার করুন: