প্রিয়াংকা কুণ্ডু:
মানুষের মন হয়তো মাঝে মাঝে বিপরীত দিকে কাজ করে। সোজা কথায় বলি, একটা আনন্দের সময়ে থাকলে তার কেন জানি দুঃখের স্মৃতি মাথায় আসে। সেমিওটিকস (সংকেত বিজ্ঞান)-নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ফ্যাঁর্দিনান্দ দ্য স্যসুর বলেছিলেন, সংকেতের মাধ্যমে অর্থ প্রকাশ হয় ‘বাইনারি অপজিশন’-এর মাধ্যমে। যেমন, ভালো বুঝতে আমরা মনে করি যেটি খারাপ নয় সেটিই।
হয়তো মনেরও এমন হয়। এই কথাগুলো বলার একটি কারণ আছে। আজ আমার এমনটিই হয়েছে। হলের টিভি রুমে বসে দেখছিলাম হিন্দি সিনেমার গান। গানের মধ্যে যুবা-যুবতীদের আনন্দনৃত্য দেখতে দেখতে আমার দুঃখি বড় চাচির কথা হঠাৎ মাথায় এলো। কেন ঠিক বলতে পারবো না। কখনোই আসে না। আসলে মনে আসার মতো, মনে করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন তিনি। বিচার বুদ্ধি যতটা কাজ করে, তাতে মনে হয় আমাদের বাড়ির সবচেয়ে অনাকাঙ্খিত, নিগৃহিত আর অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তিনি।
আজ আমি তার গল্প বলতে চাই। প্রশ্ন আসতে পারে কে এমন সে যে সময় নষ্ট করে তার কথা শুনতে হবে! সে এমন কেউ না। তবুও আমি তার কথা শুনতে অনুরোধ করবো। কারণ তার গল্প হয়তো কোন না কোন দিক থেকে প্রতিটি নারীর গল্পের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। যাহোক, তার কথাতে যাই-
নাম ভানুমতি। বয়স সঠিক জানা নেই। আনুমানিক ৬৫-৭০ বছর হতে পারে। ছোটবেলায় তার কাছে গল্প শুনেছি। তার বিয়ে, বাচ্চা হওয়া ইত্যাদির। তবে এই গল্প তিনি খুব আরামে থেকে, অবসর যাপনের জন্য বলেননি। পরিবারের বাকি সদস্য (ছেলে, বৌমা, তাদের দুই বাচ্চা)-দের মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতেন। আর এটাকে গল্প বলা বললে হয়তো ভুল হবে। কারণ তিনি মারের দমক সামলানোর জন্য কিংবা কষ্ট কমানোর জন্য হয়তো আপন মনে কথাগুলো বলে যেতেন।
আর আমি গল্প শুনি বললেও ভুল হবে। কারণ ওনার গল্প কে শুনবে? ওনার ছেলে যখন ওনাকে চেলা কাঠ দিয়ে পেটাতো, ছেলের বাচ্চারা যখন মুখের সামনে থেকে ভাতের থালা নিয়ে উঠনে ছুঁড়ে ফেলতো, আমি তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম আর মজা পেতাম। যারা তাকে কষ্ট দিত, আমি তাদের দলেরই একজন ছিলাম। কারণ সে ছোট বাচ্চাদের সামনে গালি দেয়, পাড়ায় পাড়ায় (গ্রামের অন্য বাড়িতে) ঘুরে বেড়ায়, পরিবারে কার কত আয়, কী জিনিস কেনা হলো সব মানুষকে বলে বেড়ায়, কোন কথা গোপন রাখতে পারে না।
গুল (একধরনের নেশা দ্রব্য) খায়, যেখানে-সেখানে গুলের থুথু ফেলে, ইত্যাদি নানা দোষ আছে তার। এগুলো আমি বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছ থেকে জেনেছি। কারণ তাকে পেটানোর পর সবার ভেতরে থাকা মানবিক অংশ যখন তাদেরকে প্রশ্ন করতো, তারা তখন পুরুষতন্ত্রের ভাষায় নিজেদের অপরাধবোধ ঢাকার জন্য এই সাফাই গাইতেন। তাদের কাছে শুনে আমারও মনে হতো, ‘হ্যাঁ, তাকে তো উচিত শিক্ষাই দেওয়া গেছে। আরো পেটানো উচিত’।
ভানুমতির (নাম ধরেই বলছি। কারণ সমাজের নিয়মে এই নারীর নিজের নাম বহু আগেই হারিয়ে গেছে। আমার এই লেখায় তার নিজের নামটা থেকে যাক) কাছেই শুনেছি, আনুমানিক নয় বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায়। তার বরের বয়স তখন ২০-২৫ বছর। সংসারের বড় ছেলের বৌ সে। চাট্টিখানি কথা নয়। বড়বৌ! উচ্চতায় ভানুমতি টেনেটুনে চার ফুট নাও হতে পারে। বর তার ছ’ফুটের পুরুষ। ছোট বয়সে শ্বশুর বাড়ি এসে বরকে দেখে পালাতেন তিনি। কিন্তু পালিয়ে আর কতদিন? ১২ বছরের দিকেই গর্ভবতী হলেন তিনি। পরিবার তার সন্তান জন্মানোর জন্যই অপেক্ষা করছিলো। কারণ ভানুমতি পাগল। পুরোপুরি পাগল না হলেও বুদ্ধি অনেক কম। বিয়ের আগে তো আর জানা যায়নি।
ভানুমতির শাশুড়ির মতে, ওঁর বাপ-মা পাগল মেয়ে বিয়ে দিয়ে তাদেরকে ঠকিয়েছে। এই বাড়িতে থাকার কোন যোগ্যতাই নেই ওর। ছি:! ছি:! তার বড় ছেলে একটা পাগলের সাথে সংসার করবে? সেটি তো হতে পারে না। তাই ভিতরে ভিতরে সিদ্ধান্ত হলো, বাচ্চাটি হলেই পাগল বৌকে তাড়ানো হবে। অবশেষে দিন গোনার পালা শেষ হলো। জন্ম নিলো একটি ছেলে সন্তান। যা পরিকল্পনা, সেই অনুযায়ী কাজ করা। এক সকালে শাশুড়ি আঁতুড় ঘরে ঢুকে ছেলে কেড়ে নিলো মায়ের কোল থেকে। ভানুমতির বর তাকে মারতে মারতে আঁতুড় ঘর থেকে উঠোনে নামালো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললো তাকে। কিন্তু যতোই বুদ্ধি কম থাক, সংসারে সে যতই গুরুত্বহীন হোক, নিজের নবজাত সন্তান রেখে কোনো মা যেতে চায়? সেও চায়নি। তাকে যেন পুরোপুরি তাড়ানো যায় তার সকল চেষ্টাই করা হলো। সমানে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে রাস্তায় দিয়ে আসা হলো তাকে।
দিশেহারা ভানুমতি। কোথায় যাবে তার সন্তানকে ছেড়ে? রাস্তায় বসে সারাদিন কাঁদলো সে। যদি বাড়ির মানুষদের মত বদলায়। কিন্তু তা হবার নয়। সে যে পাগল। ১৩ বছর বয়স থেকে শুরু হলো তার ভাসমান জীবন। বাপের বাড়ি, বোনের বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এক সময় চলে গেলো পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশ তখন পাকিস্তান। বড় ভাগ্যে পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক বাড়িতে সে কিছুটা করুণা পেলো। পেলো গৃহকাজের চাকরি। চাকরি আর কি, কাজের বিনিময়ে খাওয়া-–পরা।
ভানুমতি বলে, জীবনের সেই দিনগুলোই তার সবচেয়ে সুখের দিন ছিলো। বেশ ভালো ছিলো সেখানে। ২৫ বছরের বেশি সে ও বাড়িতে কাজ করেছে। কোনদিন কেউ তার খোঁজ করেনি। বাপের বাড়ির লোকেরা ঠিকানাটা রেখেছিলো কেবল।
এর মধ্যে তার জন্ম দেওয়া ছেলে বড় হতে থাকলো দাদির কাছে। তাকে বলা হলো, তার মাথা খারাপ মা তাকে রেখে চলে গেছে। তাই ছেলেও কখনো মাকে দেখার জন্য বায়না করেনি। বাবা আরেকটি বিয়ে করেছে। সেই ঘরে এসেছে তিন ভাই আর দুই বোন। এই পঁচিশ বছরে লেখাপড়া শিখে একটা চাকরিও পেয়েছে সে। এবার সংসারের বড় নাতির বিয়ে দিতে হাবে। চিন্তা দাদির মাথায়। বিয়ে ঠিক হলো। এখন প্রতিবেশীরা বলাবলি করতে লাগলো, ছেলের মা তো বেঁচেই আছে। বিয়েতে তাকে আনলে ক্ষতি কী?
যে ভানুকে পিটিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিলো, আজ তার কাছে চিঠি গেলো। সেটি আবার কোল থেকে কেড়ে নেওয়া তার ছেলের বিয়ের খবর লিখে। বেশ সুখেই ছিলো সে ও বাড়িতে। কিন্তু নিজের সন্তানকে দেখবার সুযোগ পেয়ে বর্তমান সুখ আর অতীতের দুঃখ সব ভুলে সে রওনা হলো বাংলাদেশে। কারণ পাকিস্তান ইতোমধ্যে বাংলাদেশ।
এসে দেখে সবকিছু বদলে গেছে। সতীন এসেছে। সতীনের ঘরে পাঁচ সন্তান। দেবরদের সব বিয়ে হয়ে গেছে। যখন তাকে চলে যেতে হয়েছিল, তখন বাড়িতে যে লোক ছিলো, এখন তার দ্বিগুণ। কিন্তু এখনো সে অবাঞ্ছিতই থেকে গেছে। নিতান্তই লোকনিন্দা বাঁচাতে তাকে আনা হয়েছে। এখানে তাকে কেউ চায় না। তাই কেউ ঠিক করে কথাও বলেনি তার সঙ্গে। ভানুর তো আসলেই বুদ্ধি কম। এতো কিছু কি সে বোঝে? সবার সথে কথা বলতে যায়। সবাই তাকে তাচ্ছিল্য করে।
সেই তাচ্ছিল্য নিয়েই ৬০-৬৫ বছর সে পার করেছে। ভেবে ছিলো পেটের ছেলে দুঃখী মায়ের কষ্ট বুঝবে। কিন্তু তা হয়নি। পাগল মায়ের জন্য শিক্ষিত ছেলে, বৌয়ের গ্রামে কোন সম্মান নেই। বৌমা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। রাস্তা দিয়ে সে যখন স্কুলে যায়, গ্রামের মহিলারা তার কাছে এই বলে নালিশ করে যে, তার শাশুড়ি তাদের ঘরের কথা পাড়ার মানুষের কাছে বলে বেড়ায়। গ্রামের নানা জনের কাছে শোনা এমন নালিশে কত শত দিন যে ভানুমতি মার খেয়েছে, তা কেউ গুনে রাখেনি। মারের ধকলে কতদিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছে সে।
আমরা ভেবেছি, এবার হয়তো ভানুমতি মরে গেছে। কিন্তু কৈ মাছের প্রাণ। সে মরলেও হয়তো বেঁচে যেত। পাগল মানুষ। তাই কখনো আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেনি। জীবনের প্রতি তার বড় মায়া।
ছেলে-ছেলের বৌয়ের সংসারেই সে এখন খেটে খায়। যতটুকু পারে ততটুকুই। ছেলের সংসারে সে কুষ্ঠ রোগীর মতো থাকে। অসুখে পড়লে কেউ তাকে দেখে না। সারা বছর বাড়ির বারান্দাতে বিছানা করে থেকেছে সে, এখনো তেমনই থাকে। তার বাসনাদি, কাঁথা-বালিশ, কাপড় কেউ স্পর্শ করে না। কেনই বা করবে? সে তো গুল খায়, গুলের থুথু ফেলে। সে নিজ বাড়িতেও অস্পৃশ্য। নিজের বাড়িতেই পরবাসী।
শিক্ষার্থী (এমএসএস), গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়