বাবা-মায়ের সমান দায় সন্তানের রঙিন শৈশব রচনায়

জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা:

৪/৫ মাস আগের কথা| ফ্যামিলি ফ্রেন্ডসহ এক ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি| সুন্দর এক বিচের কাছে| খুঁজে খুঁজে আমরা উইন্ডো সাইডে গিয়ে বসেছি| ‘ক্ষুধার্ত আমাদের’ কাছে খাবার আসতে দেরি হলেও, ঢেউ গুনে নিশ্চয়ই সময় কেটে যাবে~ বসেছি, এ ভাবনাতেই! আমরা বসার পরপরই দেখি, বাচ্চাকাচ্চা সহ বেশ বড় একটা অস্ট্রেলিয়ান গ্রুপ এসে বসলো ঠিক আমাদের সামনে|

আর কেউ কিছু ভেবেছিলো কিনা জানি না, আমি সামান্য বিরক্ত হলাম! ভাবলাম, নিজের মেয়ের যন্ত্রণায়ই টেকা দায়, এখন এই লাঞ্চে যুক্ত হবে আরো চারটার হাউকাউ! আমার মেয়ে যথারীতি তার জ্ঞান বিতরণ এর রেডিও অন করে দিলো!

…”মা জানো, আমার জন্য যেই প্রনটা অর্ডার দিয়েছ, তা কিন্তু এই বিচ থেকেই ধরা হবে| ….আর তুমি যেই ‘ভেজিটেবল রিসোত্তো’ অর্ডার করেছো তা কিন্তু সমুদ্র থেকে আসবে না! বাজার থেকে কিনতে হবে| বুঝেছো মা, তোমার খাবার আসতে দেরি হবে…” ক্ষুধায় পেট চো চো, এই অবস্থায় তার এলোমেলো কথায় হু হা করছি আর ভাবছি – খাবার আসবে কখন! খাবার দাবারের গল্প শেষ করে, কন্যা এবার সমুদ্রের ঢেউ-পাখি এদের সম্পর্কেও নানাবিধ অজানা(!) গল্প শোনালো| সব শুনিয়ে, এবার তার জ্যাকেট খুলতে ইচ্ছা হলো| কিছুক্ষণ পর জুতা-মোজা, টুপিও! তারপর শুরু হলো, চামচ দিয়ে শূন্য প্লেটে আঁকাআঁকি| আর চামচ-কাঁটাচামচের ঝনঝনানি! এইসব রেস্টুরেন্টে খাবার আসতে বরাবরই দেরি হয়|

এদিকে কন্যা’র উত্তরোত্তর এক্টিভিটিজে অতিষ্ট হয়ে পাশের টেবিলের বাচ্চাদের দিকে তাকাতে বললাম| আমি না তাকিয়েই বলে চললাম, ‘দ্যাখো, চার চারটা বাচ্চা এখানে বসে আছে| দুইটা ছেলেমেয়ে ঠিক তোমারই বয়সী আর দুজন তোমার থেকে একটু বড়| অথচ ওখান থেকে শব্দ আসছে কোনো? তুমিই শুধু এত হৈচৈ কর!’

আমার মেয়ে মিনমিন করে বলল, “কিন্তু মা, আমি তো ফান করছি| ওরা করছে না|” ‘… হ্যা, শুধু তুমিই ফান করো, আর কেউ করে না?’

-বলতে বলতে ওদের দিকে তাকাতেই কেমন স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! চার সিটের এক টেবিলে, দুজন পুরুষ এবং দুজন নারী| রিলেটিভ অথবা ক্লোজ ফ্যামিলি-ফ্রেন্ড হবেন, একে অপরের| খুব হেসে, হাত নেড়ে আনন্দময় সময় কাটাচ্ছেন, ঠিক আমাদের মতো করে| তাদের পাশের টেবিলেই, চারটা অনিন্দ্য সুন্দর বাচ্চা (৪ থেকে ৭/৮ বছরের) ভ্রু কুঁচকে পাথর-মুখে, ট্যাব অথবা আইপ্যাডে মুখ গুঁজে বসে আছে|

মনে পড়ে গেলো, ওরা আসা অবধি একটা শব্দও ওদের কাছ থেকে আসেনি| রেস্টুরেন্টে ঢুকছিলও কেমন ভাবলেশহীন গম্ভীর মুখেই! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল| এ দৃশ্য এখানে নতুন নয়| বাঙালি দাওয়াতগুলোতেও হরহামেশা দেখতে হয়! তবু কী যে হলো, মনটাই খারাপ হয়ে গেল| আমাদের ছোটবেলায়, বাসার বাচ্চারা সবাই খুব ‘বিচ্ছু টাইপ’ থাকলেও, গেস্ট আসলে বাসার আনাচে কানাচে পালিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যেতাম|

না পালিয়ে কী উপায়? সামনে পড়ে গেলেই যে বাসার বড়রা নতুন শেখা কবিতাটা শোনাতে বলবেন! কিন্তু বেশিক্ষণ আড়ালে থাকা সম্ভব হতো না, যদি গেস্টদের মাঝে সমবয়সী কোনো বাচ্চাকে দেখা যেত! দুমিনিটেই সবার সাথে সবার হৈহৈ করে খেলা, কত রাজ্যের গল্প~ শেষে তারা দারুণ বন্ধু হতো! আর একসাথে কোথাও ঘুরতে গেলে তো কথাই ছিল না!

…বিষন্ন হয়ে খাবার খেতে শুরু করলাম| বুঝলাম, ওদের খাবারও এসে গেছে| তাকাবো না, তাকাবো না করেও, শেষে বাচ্চাগুলোর টেবিলে তাকিয়ে ফেললাম| মনে হলো, কতগুলো ‘শিশু রোবট’ খাচ্ছে| যারা কী খাচ্ছে, কেমন খেতে লাগছে কিছুই ভাবছে না! বিরক্ত চোখে, একহাতে গেমসে ডুবে গিয়ে; আরেক হাতে কোনোমতে খাচ্ছে| বাচ্চাগুলো বেড়াতে বেরিয়েছে, বেড়ানো শেষে বাইরে খাচ্ছে… কিন্তু ওরা আসলে এগুলোর কিছুই করছে না! ওরা স্কুল/কিন্ডারের বাইরে বাসায় রোজ যেটা করে, সেটাই শুধু করছে|

আচ্ছা, আমরা কী ভেবে দেখেছি~ ধীরেধীরে, আমাদের এই বাচ্চাগুলো বড় হবে! বড় হবে ভয়ঙ্কর এক ‘আইসোলেশন’ নিয়ে| আমাদের প্রানপ্রিয় এই বাচ্চাগুলোর কথা আমরা বুঝতে পারব না, তারাও বুঝবে না আমাদেরকে| এমনকি, তারা তাদের নিজেদেরকেও ঠিক মতো বুঝবে না| একটার পর একটা এক্সাইটিং গেইম, টিভি প্রোগ্রাম ~ কোনো কিছুই তাদেরকে বেশিক্ষন আনন্দ দিতে পারবে না! কথায় কথায়, তারা বলবে~ ‘উফফ বোরিং লাগছে’| চিরস্থায়ী এক বিষন্নতায়, তাদের জীবন আটকে যাবে!

আমাদের সাথে আসা ফ্যামিলি ফ্রেন্ড মেয়েটি, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা মনে হলো – বুঝতে পেরেছে| সে তার পেটের মাঝে বড় হতে থাকা বাবুটির গায়ে হাত বুলিয়ে বললো, “দৃশ্যটা ভয়ঙ্কর, তাই না আপু? তবে খুব একটা আনকমন না কিন্তু!” আমি হঠাৎ কেমন মরিয়া হয়ে তাকে আর তার হাজব্যান্ডকে বলেছিলাম, “প্লিজ তোমরা তোমাদের বাবু’র আনন্দময় ছেলেবেলাটি এমন নষ্ট হতে দেবে না! প্লিজ!”

পরিচিত কাউকে তাদের বাচ্চার জন্য বলতে গেলে, খুব বিরক্ত হোন! ভাবেন, আমি আদিখ্যেতা করছি! আর একান্তই যদি কেউ সমস্যাটি ধরতে পারেন, তো ভেবে নেন, এ দায়িত্ব নিতান্তই বাচ্চা’র মায়ের! কিন্তু সত্য হলো বাচ্চা’র দায় এবং দায়িত্ব সমানভাবে দুজনের| বাবা এবং মায়ের| সবাই ইদানিং খুব ব্যস্ত, এও সত্যি| কিন্তু তবু, এর মাঝেও বাচ্চাকে সময় দিতে হবে| সময় দিতে হবে বাবা-মা দুজনকেই! ছবি-ছড়া-গল্প এবং আশপাশে ছড়িয়ে থাকা গাছ-আকাশ-মেঘ নিয়েও বাচ্চাকে ব্যস্ত থাকা শেখাতে হবে| নইলে, সে একদিন নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে!

যন্ত্র বেশিদিন বন্ধু থাকে না…. এগুলো আমার কথা না! এখানকার সমাজবিজ্ঞানীরা, মনোবিজ্ঞানীরা নিয়মিতই এ কথা বলে চলেছেন! আমরা ঘন্টা তিনেকের বেশি ছিলাম, সেদিন সে রেস্টুরেন্টে| ওঁরা আমাদের আগেই উঠলেন| দেখলাম ~ হাসিখুশি মা-বাবাগুলোর পিছে পিছে চারটে নীল চোখের, সোনালী চুলের দেবশিশু মূর্তির মতোন হেঁটে যাচ্ছে| হ্যা, মূর্তির মতোই…….. এই দৃশ্যটা এ ক’মাসে অনেকবার চোখে ভেসেছে| আমি প্রতিবার সে দৃশ্য তাড়িয়েছি, তাদেরকে উচ্ছল-হাসিমুখের দৃশ্যে কল্পনা করে! কিন্তু কল্পনায় আর কতটুকুই বা বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়!

…শৈশবে যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল বাচ্চাগুলো, বড় হয় নিদারুণ নিঃসঙ্গতায়| পরে এই বাচ্চাগুলো, কে কি করছে~ মা বাবা আর জানতে পারে না! এদেরই কেউ তখন খুব সহজেই ভুল জীবনের ফাঁদে পা বাড়ায়|| ভবিষ্যতে কে কি হবে তা আমরা কেউ জানিনা| তবু, ‘শিশুর আনন্দময় একটা রঙিন শৈশব থাক’ -আপাতত শুধু সেটাই চাই| পরিণত বয়সে ‘যে শৈশব’ তাকে ‘রোম্যান্টিক-নস্টালজিয়া’য় যখন তখন ভাসাবেই….!

সুতরাং বাবা এবং মা, এগিয়ে আসুন দুজনেই!!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.