পুরুষ মানুষ যখন পুরুষতন্ত্রের শিকার

মাহসিনা আফরোজ ইলা:

রাত দশটায় জনৈক পুরুষ বন্ধুর ফোন। ফোন ধরা, ইনবক্সে রিপ্লাই করা ইত্যাদি কাজে আমি খুবই খামখেয়ালী। বিশেষ করে ফোনের বেলায়। কথা বলায় বেজায় আলসেমি আমার। কী মনে করে ফোনটা ধরলাম।

হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে অগ্নি বর্ষণ, ‘খুব সমান অধিকারের কথা বলো, আর আমার যে সবসময় অটোতে মাইয়া মানুষরে জায়গা দিতে গিয়া ড্রাইভারের পাশে বসা লাগে? ক্যান, মহিলারা ড্রাইভারের পাশে বসতে পারে না?’ উল্লেখ্য আমার বন্ধুর কর্মক্ষেত্র যেখানে, সেখানে যাতায়াত এর গণমাধ্যম বলতে অটোরিকশা।

আমার তো শুনে মেজাজ ফরটি নাইন। কিছুদিন আগে গণপরিবহনে মেয়েরা যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হয়, তাই নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। স্বভাবতই সেখানে আক্রমণের বিষয়বস্তু ছিল যারা এ ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি করে সেসব পুরুষযাত্রী। এমনিতে বকবক করতে ভাল্লাগে না, তার উপর এই ব্যাটা কীসব আউল ফাউল বলতেসে! আমিও সঙ্গে সঙ্গে গলা চড়িয়ে বললাম, ‘ওই ব্যাটা! ড্রাইভারের পাশে তোর বউরে বসাবি?’

সে একটু থতমত খাইলো। বললো, ক্যান? আমার বউ বসবে ক্যান? সে লাগলে পুরা অটো রিজার্ভ করে যাবে। আমি বললাম, ও আচ্ছা। তুমি মিয়া বড়লোক মানুষ, তোমার বউ এর পুরা অটো রিজার্ভ করার সামর্থ্য আছে, তাই তার জন্য অন্য নিয়ম। আর যে মহিলারে জীবন জীবিকার তাগিদে রাস্তায় বের হতে হয়, তারে তোমার মতো পুরুষ লোকরে জায়গা দেওনের লাইগা ড্রাইভারের পশ্চাদ্দেশে পশ্চাদ্দেশ ঠেকায়ে বসতে হইবো?

উত্তরে ও কী যেন কাউমাউ করলো। ফোন রেখে দিতে গিয়ে মনে হলো, এইটা তো ঠিক স্বাভাবিক আচরণ না। এমনিতে যে ধারণাই পোষণ করুক না কেন, এমন অমার্জিত আচরণ করার মতো মানুষ না সে। ওর সমস্যাটা কী? হাজার হোক বন্ধু মানুষ। আমি সুর নরম করে বললাম, কী হইসে তোর? ও তখন বললো, স্যরি দোস্ত, আমার মনটা খারাপ বিভিন্ন কারণে। এইজন্য তোরে ফোন দিয়া একটু চিল্লাইলাম। আমি বললাম, ওকে। চিল! এখন কী হইসে ক। উত্তরে ও যা বললো, তাতে প্রথমে খুব হাসি পেল। তারপর ভেবে দেখলাম, বিষয়টা আসলেই মন খারাপ করার মতই।

আমার বন্ধু উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তার স্ত্রী উচ্চ পদস্থ না হলেও, সরকারি চাকুরিজীবী। ও যেহেতু পুরুষ, তাই সংসারের যাবতীয় অর্থনৈতিক দায়িত্ব তার। স্ত্রী এই দায় থেকে মুক্ত। ইদানিং বউ এর সঙ্গে খুঁটিনাটি বিষয়ে বেশ মন কষাকষি চলছে। এক পর্যায়ে বউ কখন কোন উপলক্ষে কত টাকা খরচ করেছে তার ফিরিস্তি দিতে বসলে সে তার মুখের উপর বেশ মোটা অংকের টাকা ছুঁড়ে মারে এবং বউ নির্বিকারভাবে তা তুলে নিয়ে নিজের ব্যাংক একাউন্টে জমা রাখে।

আমি শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম। সে বললো, প্লিজ হাসিস না। আমার সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা কর। মানব চরিত্রের কমন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এহেন পরিস্থিতিতে লাভ ক্ষতি হিসাব কষতে গিয়ে বেচারার মাথায় হাত। সংসারের পেছনে ব্যয় করতে করতে সে প্রায় নিঃস্ব। এদিকে বউকে যেহেতু ফুটো পয়সাও খরচ করতে হয় না, তার ব্যাংক ব্যাল্যান্স দিন দিন ভারি হচ্ছে।

বন্ধুর ভাষ্যমতে, বউ যে তার সুযোগ-সুবিধার দিকে ফিরে তাকায় না এর মূল কারণ সে ইকনোমিক্যালি এম্পাওয়ারড। এবং এটা হবার সুযোগ সে পেয়েছে আমার বন্ধুর পূর্ণ সহযোগিতায়। কিন্তু বউ এর সঞ্চিত অর্থে তার কোনো অধিকার নেই। কারণ পুরুষ হয়ে বউ এর উপার্জনে ভাগ বসালে তার মেইল ইগো আহত হয়। এ পর্যায়ে আমার তার প্রতি শ্রদ্ধা জন্মালো। অন্তত সে এখনো আমাদের বাবা, চাচাদের আমলের পুরুষতন্ত্র ধারণ করে আছে। বউ এর ভরণপোষণের পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই সে পৌরুষ ফলায়। এখন আবার আমার অন্য পুরুষ বন্ধুরা বলতে আইসেন না যে বউরে চাকরি করতে দিসে ক্যান ব্যাটা? চাইলেই সবাই সব কিছু করতে পারে না। সামাজিক অবস্থান বলে একটা বিষয় আছে। নিন্দা মন্দ পুরুষকেও শুনতে হয়। উত্তম পুরুষরা এগুলা শুনতে চায় না।

বিষয়টা আমি যতই ফান করে বলি না কেন, পুরুষতন্ত্র যে পুরুষের উপরই কখনো কখনো বুমেরাং হয়, এটা তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। সব নারীই যে মায়াবতী, তা কিন্তু নয়। সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়ম কানুনের আওতায় থেকে কড়ায় গণ্ডায় নিজের অংশটুকু বুঝে নিতে অনেকেই জানে। তখনই পুরুষ মহলে কান্নার রোল ওঠে। তারা বলে, হে মানব জাতি! তোমরা নারী নির্যাতন নিয়ে সোচ্চার, কিন্তু পুরুষ নির্যাতন নিয়ে নও কেন? আমার তখন বলতে ইচ্ছে হয়, হে পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু এবং প্রিয়তমগণ, বৈষম্যের নিয়ম যখন বানিয়েছো, তখন তার ফাঁদে কখনো না কখনো তোমাকেও পড়তে হবে। ইহাই প্রকৃতির নিয়ম।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.