ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
পরপর তিন থেকে চারটে ফোন কল আমাকে একটা ভাবনার মধ্যে ফেলে দিলো। খানিকটা থমকে যাই। কলগুলো পাই পরিচিতজন, কাছের মানুষদের কাছ থেকে। ভিন্ন ভিন্ন কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া কয়েকজন দিশেহারা মানুষ তাদের কঠিন মানসিক বিপর্যয়ে আমাকে বিশ্বাস করে মনের কথা খুলে বলতে চায়।
মানুষের অন্তর্দহন আমাকে বিচলিত করে। কারো আস্থাভাজন হতে পেরে সম্মানিত বোধ করি। কিন্তু এই আস্থার প্রতিদান কীভাবে দেব সে চিন্তাতেই থমকে থাকি।
জীবনে চলার পথে দেখা, ঠেকে শেখা, কুড়িয়ে পাওয়া টুকরো টুকরো অজস্র ঘটনা, দুর্ঘটনা, নিপীড়ন বা অসংগতি কখন যেন অজান্তে আমার লেখার মধ্যে উঠে আসতে শুরু করেছে ! পরিবার থেকে আমি শিখেছি নিজেকে নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র এসবের বাইরে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে। নারী – পুরুষের বৈষম্যকে থোড়াই কেয়ার করলেও জীবনের সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে আমি আমার চারপাশে থাকা নারীদের মাঝে আত্মীয়, বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত মানুষ হিসেবে যে অস্তিত্বের লড়াই দেখেছি, তা উপেক্ষা করা বা এড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এক সময় উপলব্ধি করলাম , প্রত্যেকটি মেয়ের যাপিত জীবনের পেছনে আলাদা আলাদা গল্প আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই গল্প গুলোতে লুকিয়ে থাকে অনেক অপমান, অবহেলা, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, নিপীড়ন, না বলা আরো অনেক কথা।
যে মেয়েটির আত্মবিশ্বাসী চলাচল অন্যকে পথ দেখাবে বলে মনে হতো , মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই মেয়েই যখন বলে কোনো কাজেই সে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়না তখন আমি আরো একবার থমকে যাই।
একজন মা তার সন্তানের বিপথগামী হওয়া অবধারিত বুঝতে পেরেও যখন তার অবাধ্যতার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে , তার বিক্ষিপ্ত মন আমার হৃদয় স্পর্শ করে।
কিছুটা অবাক হই, সেই সাথে আশাবাদী হই তারা নিজেরাই পেশাদার কারো সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করছেন শুনে। সমস্যার গুরুত্ব ও গভীরতা তারা বুঝতে পারছেন। বুঝতে পারছেন যে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি, কারো সহায়তা তাদের দরকার। তাই নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছেন নিজের কষ্টের কথা কারো সাথে ভাগাভাগি করে নিতে। নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে মেলে ধরার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
অনেক আগে বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকায় দেখতাম, মানসিক সহায়তা দেবার জন্য আলাদা বিভাগ থাকতো । আমাদের এখানেও কিছু পত্রপত্রিকায় এমন বিভাগ চালু ছিল। তবে এখনকার তুলনায় কম। জীবনের জটিলতায় মানুষের মধ্যে আগের চেয়ে সচেতনতা বেড়েছে।
“কাউন্সেলিং” শব্দটা এখন অনেকটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। আগে যেমন মানসিক সহায়তায় পেশাদার মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হবার কথা উঠলে মানুষ অপমানিত বোধ করতো। ভাবতো, তাকে পাগল ভাবা হচ্ছে। আমার কাছে ” পাগল “খুব অসংবেদনশীল একটি শব্দ। অতি সহজেই আমরা কাউকে পাগল বলে বসি, এ নিয়ে হাসাহাসি করি। অথচ একবারও ভাবি না, মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের জন্য এই ” পাগল ” কথাটি বা এ নিয়ে রসিকতা কতটা অমানবিক হতে পারে।
আগে পাগলদের চিকিৎসা বলতে আমরা পাবনা মানসিক হাসপাতাল বুঝতাম, যাকে সবাই ‘পাগলা গারদ’ নামের আরো একটি অসংবেদনশীল নামে অভিহিত করেছে।
আমূল পরিবর্তন না এলেও দিন কিন্তু পাল্টেছে।
নিজের কথা বলতে পারি, আমি কোনো মনোচিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ নই। ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই এই সংক্রান্ত কোনো লেখা চোখে পড়লে পড়তে শুরু করি। টেলিভিশনে এ নিয়ে দুই একটা ভালো অনুষ্ঠান পেলে দেখার চেষ্টা করি। পত্রিকার এক কোণের এই ছোট্ট মন জানালায় চোখ রাখতে রাখতেই এক সময় আমার মনের দখিন দুয়ারে বাতাস বইতে শুরু করলো। সমস্যার পাশাপাশি খুব খেয়াল করি বিশেষজ্ঞ পরামর্শগুলো। ড. মোহিত কামাল, ড.মেহতাব খানমের লেখা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের বক্তব্য থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করি। ভালো লাগে নারী- পুরুষের জটিল সম্পর্ক নিয়ে সারা যাকেরের আধুনিক মনোভাব।
বাংলাভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ” আমি এখন কী করবো? ” সবার দেখা উচিৎ বলে মনে করি।
খোলামেলা আলোচনা এবং উদার, আধুনিক দৃষ্টিভংগির কারণে অপর্ণা সেন সম্পাদিত সানন্দার নিয়মিত পাঠক ছিলাম। একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ” ভালো আছি, ভালো থেকো ” নামের অনুষ্ঠানটি দেখি মাঝেমধ্যে। দেখে মনে হয়েছে এঁরা সত্যিই সবাইকে ভালো রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি ” কান পেতে রই ” নামের একটি চমৎকার সংস্থার সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে। যে কোনো মানসিক সমস্যায় “কান পেতে রই ” ফোনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। যাদের পক্ষে সরাসরি কাউন্সেলিং এ যাওয়া সুবিধাজনক নয়, তারা চাইলে ফোনে তাদের মনের কথাগুলো জানিয়ে পরামর্শ নিতে পারেন। আত্মহত্যা প্রবণতারোধেও এই প্রতিষ্ঠানটি গত চার বছর ধরে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে ।
বাড়িতে মাকে দেখেছি খুব ভালো কাউন্সেলিং করতে। পেশাদার না হলেও এই কাজে তাঁর সহজাত দক্ষতা উদাহরণ দেবার যোগ্য। চেনা – অচেনা বহু মানুষ তাঁর কাছে এসে কিছুক্ষণ বসে জীবনকে নতুনভাবে দেখার প্রেরণা নিয়ে ফিরে গেছে।
শরীরের যেমন অসুখ হয় মনের অসুখ হওয়াটা ঠিক তেমনি স্বাভাবিক। শরীরের অসুখ হলে যেমন ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, মনের বেলাতেও তাই যাওয়া উচিৎ যদি তা নিজের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।
শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে, পুড়ে গেলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেই কারণ সেই যন্ত্রণা দৃশ্যমান। অথচ মনের ভেতরের ক্ষতটাকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে তা কতখানি গভীরে পৌঁছে যায় কেউ তার খবর রাখি না। এভাবেই বিষণ্ণতার কাছে, মাদকের নেশায় এমনকি আত্মহত্যার কাছে কেউ কেউ পরাজয় স্বীকার করে নেয়।
মনের কথা অকপটে বলবার মত জায়গা দরকার। সাহস দরকার। উইমেন চ্যাপ্টারকে ভালোবাসি কারণ সেখানে নিজেকে মেলে ধরার সেই পরিবেশটা পাই। যা হয়তো অন্য কোথাও কোনোদিন বলা সম্ভব হয়নি কত সহজেই এখানে তা বলে ফেলি আমরা।
আমার অতি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নিজের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর মতো আনন্দ আর কিছু হতে পারে না।নিজেকে ভালোবাসতে ভুলবেন না। নিজের ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দিন। মনের ভেতর নিজের জন্য একটু জায়গা রাখতে হবে যাতে আঘাত এলেও নিজেকে নিজেই আশ্রয় দেয়া যায়। বাইরে কাজের ক্ষেত্রই হোক বা সংসারের ব্যস্ততাই হোক কোনো কিছুর চাপে আপন সত্তা হারিয়ে ফেলবেন না। নিজেকে সময় দিন। একাকি সময় উপভোগ করুন। আমার মনে হয়, আনন্দ, উচ্ছ্বাসের মতো বেদনাা, দুঃখবোধ বা মন খারাপও মনের একটি অবস্থা, অভিব্যক্তি। তাকে ভয় না পেয়ে বরং জয় করুন। সমস্যার শুরু তখন থেকে যখন অন্য সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের প্রতি দায়িত্বের কথা আমরা বেমালুম ভুলে বসি। ভুলে যাই যে, অন্যকে ভালো রাখতে গেলেও নিজের ভালো থাকা চাই।
ভেতরের অবসাদ, বিষাদ পুষে দমবন্ধ জীবনে তিলে তিলে ক্ষয়ে যাওয়া থেকে মুক্তি পেতে যারা খোলা বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চান তাদেরকে অভিবাদন।
ঈর্ষা, ক্রোধ, সমালোচনা, গসিপ ভুলে গিয়ে আসুন না আমরা একে অন্যকে একটুখানি শুনি , বলতে দেই , বাঁচতে সাহায্য করি।
শেয়ার করুন: