মায়ের পাশে দাঁড়াও হে পুত্রসন্তান!

মাহসিনা আফরোজ ইলা:

প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাসের মাথায় আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে যখন জানতে পারলাম আমার দ্বিতীয় সন্তানও ছেলে, খুব মন খারাপ হয়েছিল। শখ ছিল একটা মেয়ে বাবুর। ওর মধ্য দিয়েই আবার নিজের শৈশবে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। ফুটফুটে একটা মেয়ে হতো আমার। পরীর মতো সাজাতাম। নাচ শিখাতাম, গান শিখাতাম। স্কুলের প্রোগ্রামে বেণী দুলিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতো। পাকা বুড়ির মতো কট কট করে কথা বলোত।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমার মেয়ে হতো আমার সন্তান, ঠিক রাইদ, আমার বড় ছেলে যেমন। দেখিয়ে দিতাম, ছেলে আর মেয়ের মধ্যে এক কণা পরিমাণ বৈষম্য না করে কিভাবে ওদের লালন-পালন করা যায়। অনেকে অবাক হতে পারেন এই ভেবে যে, এ আবার কেমন কথা! এখনকার যুগে ছেলে, মেয়ে কেউ পার্থক্য করে নাকি? বিশ্বাস করুন, করে। যেই মুহূর্তে বলে, আমার মেয়েকে সব রকম সুযোগ সুবিধা দিয়ে বড় করেছি, সেই মুহূর্তেই করে। ছেলেমেয়ের মধ্যে সম্পদের অসম বণ্টনকে যে বাবা মা চ্যালেঞ্জ না করে, তারা করে। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েকে যারা পর ভাবে, তারা করে।

সে যাই হোক, ছেলে হোক আর মেয়ে হোক সন্তান তো সন্তানই। মনকে প্রবোধ দিতে শুরু করলাম। মেয়ে নাই কপালে কী করার। নিজেকে সান্তনা দিতে দিতেই দারুণ একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়। এই যে আমার দুটো ছেলে হল, এটা কিন্তু একটা বড় সুযোগ। আমি যে বৈষম্যপূর্ণ সমাজে বড় হয়েছি সেই সমাজটাকেই বদলে দেওয়ার।

কীভাবে? আমার ছেলে দুটোকে এই শিখিয়ে বড় করে যে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে শারীরিক গঠনে পার্থক্য ছাড়া আর তেমন কোন পার্থক্য নেই আসলে। একজন মানুষের যে সব দোষ, গুণ, ভাল, মন্দ এবং অধিকার রয়েছে, একটা ছেলেরও তা রয়েছে, একটা মেয়েরও তা রয়েছে। দোষ, গুণ, অধিকার কেউ জেন্ডার সূত্রে ইনহেরিট করে না।

যদিও কাজটা সহজ না। জন্মের পরে আমরাই ওদের আলাদা করে দেই। ছেলেদের জন্য নীল রঙ, মেয়েদের জন্য গোলাপি। মেয়েরা খেলনা পাবে পুতুল আর ছেলেরা পাবে গাড়ি, বন্দুক। তারপরেও আমার ছেলেদের সব রকম সেক্সিস্ট আচরণ এবং ধারণা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাব। আমাদের দেশে মানুষের মত মানুষ একটা মেয়ের চেয়ে মানুষের মত মানুষ একটা ছেলের প্রভাব অনেক বেশি। সমাজ বদলে দেওয়ার ক্ষমতা একটা মেয়ের চেয়ে একটা ছেলের বেশি। সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটা ছেলের যতখানি ক্ষমতা তার চেয়েও বেশি প্রতিষ্ঠা পাওয়া মেয়ের ক্ষমতা তার অর্ধেকও না। মেয়েরা হাজার প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে পড়াশুনা করে, স্বাবলম্বী হয়ে আগ বাড়িয়ে ছেলেদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।

হ্যাঁ, সেই দায়িত্ব সমাজ তাকে উদারভাবেই দিয়েছে। বাউন্ডুলে, অকর্মণ্য ছেলে যখন বাবা-মা’র দায়িত্ত নিতে অপরাগ তখন মেয়েটার কাঁধে সানন্দে সংসারের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন অধিকারের কথা আসে তখন কিন্তু সেই একই সমাজ তার সেই চিরাচরিত সংস্কারেই ফিরে যায়। অপদার্থ ছেলের বোঝা হালকা করো, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তার বদলে সমান অধিকার দাবি করো না। মেয়ের যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে ছেলের জীবনযাপন সহজতর করে তোলা বৈষম্যর এটা সবচেয়ে আধুনিক আর বাজে রূপ।

তো, এহেন সমাজে আমার ছেলেরা যখন বড় হবে তখন স্বভাবতই কিছু বাড়তি গুরুত্ব পাবে, আফটার অল ফার্স্ট জেন্ডার বলে কথা! এবং সেই গুরুত্ব পাওয়া আমার পুত্র ধনেরা যখন এই চালিয়াত সমাজের চালিয়াত নিয়ম কানুনের কান মুচড়ে ধরবে, তখন আর যাই হোক ওদের দিকে হা রে রে রে রব তুলে দাঁত, নখ বের করা একদল মানবরূপী জীব ছুটে আসবে না। আমাকে সব সময় ওদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবে না। কখনো কোন দুর্ঘটনার শিকার হলেও অসম্মানের ভয়ে মুখ লুকাতে হবে না।

একটা কথা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, এই সমাজে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ আর সহিংসতা রুখতে পুরুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ জন্মসূত্রেই তারা সুবিধাপ্রাপ্ত (প্রিভিলেজড)। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়েই ওদেরকে ওদের মা এবং মায়ের স্বজাতির পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.