সকাল সকাল হিন্দু গান!!!

শাশ্বতী বিপ্লব:

“সকাল সকাল হিন্দু গান গেয়ে দিন শুরু করবো নাকি। আমার বাসা থেকে নিষেধ আছে। আমিতো কোনদিনও যাই না। টিচার যেন ক্লাস চেক করতে এসে খুঁজে না পায় সেইজন্য লুকিয়ে ছিলাম।”

উত্তর শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ক্লাসে আমরা প্রায় চল্লিশ জন মেয়ে। আমি সাধারণত অ্যাসেম্বলির শুরুর দিকে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতাম। পিংকি যে এ্যাসেম্বলিতে যায় না সেটা কখনো খেয়াল করিনি।

পিংকি (ভালো নামটা মনে নেই) আমার স্কুলের সহপাঠী। ১৯৮৮ কী ৮৯ সালের ঘটনা। একদিন অ্যাসেম্বলি থেকে ক্লাসে ফিরে ওকে বেঞ্চের নিচে আবিষ্কার করলাম। আমার বিস্মিত প্রশ্নের এভাবেই উত্তর দিয়েছিলো ও।

জাতীয় সংগীত হিন্দু গান!! সেই প্রথম এই ধরনের মানসিকতার সাথে আমার পরিচয়। পরবর্তীতে এমন আরো মানুষের সাথে আমার দেখা হয়েছে যারা জাতীয় সঙ্গীতকে হিন্দু গান মনে করে এড়িয়ে চলে। যে মানুষটি পারিবারিকভাবে জাতীয় সংগীতের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেড়ে উঠছে সেতো এই দেশটাকেও ঘৃণা করে। 

পিংকি এখন কোথায় আছে জানি না। ওরও নিশ্চয়ই আমার মতো সংসার, সন্তান হয়েছে। ওরা কি এখনও জাতীয় সংগীতকে হিন্দু গান মনে করে? করার সম্ভাবনাই বেশি।

কিছুদিন আগে এক সেমিনারে শুনলাম, দেশের মাধ্যমিকে পড়া মেয়েদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মাদ্রাসার ছাত্রী। আবার ৪০ শতাংশ মাদ্রাসায় বাংলা পড়ানো নিষিদ্ধ!

কত হবে এদের সংখ্যা? আমার জানা নেই। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে যদি এক-তৃতীয়াংশও এই মানসিক তার হয়, তবে প্রায় ৫ কোটির উপরে। নেহায়েত কম নয় সংখ্যাটা। এই মানুষগুলো কী ভাবে এই দেশটাকে নিয়ে? কেনই বা অমন অদ্ভুত রকমের চিন্তাধারা তাদের? সেটা জানা এবং বোঝা দরকার আমাদের। নাকি এদের বাদ দিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে চাই?

সেদিন ফারজানা রূপার এক প্রতিবেদনে দেখলাম মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। কেন? তারা কি এই দেশের বাইরে? সরকারী হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজারের মতো মাদ্রাসা আছে। এই মাদ্রাসাগুলোতে যখন একটি ছোট্ট শিশুকে ভর্তি করা হয় তখন সে আমার আপনার সন্তানের মতোই কোমলমতি থাকে। কালক্রমে সে যখন মুলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, নিজেকে চারপাশের সাথে মেলাতে পারে না, তার জন্য কাজের সুযোগ থাকে না, জগৎটাকে তখনতো সে তার শেখা ও জানা জ্ঞান দিয়েই বিচার করে। সাথে যোগ হয় হতাশা ও ক্রোধ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে অচ্ছুত করে রেখে আর যাই হোক সামগ্রীক উন্নয়ন সম্ভব নয় বোধ হয়। যেমন সম্ভব নয় আদিবাসীদের দুরে রেখেও।

দেশের একটি অংশ (তার সংখ্যা যাই হোক) যদি  নিজেদের দেশ সম্পর্কে, কৃষ্টি সম্পর্কে, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার, শেখার সুযোগ না পায় তবে তাদের কুপমন্ডুকতাকে, দেশ বিমুখকতাকে একতরফাভাবে কতটুকু দোষ দেয়া যায়? মাঝে মাঝে ভাবি, দোষ ধরতে আমরা যতটা তৎপর, তার কতটুকু তৎপর তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে।

সম্প্রতি সরকার কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরা-ই হাদিসকে মাস্টার্স এর সমমর্যাদা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সেটা নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রথম ধাক্কায় হতাশা জানিয়েছি আমিও। কিন্তু পরে মনে হলো এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যদি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মুল জনস্রোতের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে তাতে বরং লাভই বেশি। সেইদিক থেকে চিন্তা করলে এই স্বীকৃতির ঘোষণা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করলো।এটাকে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমি দেখতে চাই। এবং এর ধারাবাহিকতায় পাঠ্যক্রম সংশোধন, পরীক্ষা প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়নও দেখতে চাই।

মাদ্রাসাগুলোকে মূল শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত করা ও তাদের কারিকুলামকে মানসম্পন্ন করার দাবীতো অনেকদিনের। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। প্রতিরোধ যেমন আছে বাহির থেকে, তেমনি ভেতর থেকেও। এই মাদ্রাসাগুলোকে মূল ধারায় আনতে না পারলে দেশের ভেতরে আরেক দেশ, মূল জনগোষ্ঠীর ভেতর বিচ্ছিন্ন একটি জনগোষ্ঠীকে জিইয়ে রাখা সম্ভব। সম্ভব তাদের বিচ্ছিন্নতা, হতাশাকে পুঁজি করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটা।এর আগেও কয়েকবার চেষ্টা করে বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হতে দেখেছি আমরা।

আবার মাদ্রাসার দিকে এককভাবে আঙ্গুল তুললে পুরো গল্পটা বলা হয় না। আমার স্কুলটা মাদ্রাসা ছিলো না। তবুও সেখানে পিংকির মতো শিক্ষার্থী ছিলো এবং এখনো আছে। যার প্রমাণ খুঁজতে খুব কষ্ট করতে হয়না। যারা মন্দির ভাঙ্গে, ফটোশপ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধায় বা হিন্দু সহপাঠী/ সহকর্মীকে মালু বা কাফের বলে ডাকে, তারা সবাই মাদ্রাসার ছাত্র নয়। মাদ্রাসার ছাত্র নয় সিলেট, নারায়ণগঞ্জ বা কানসাটের জঙ্গীরা।  

শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে যখন আর্থিক মুনাফার নেক্সাস তৈরি হয় সেটা মারাত্মক বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। যার থেকে মুক্ত নয় মাদ্রাসার পাশাপাশি চারদিকে আগাছার মতো গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোও।

তাই প্রাইভেট স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও সরকারী নিয়ন্ত্রণে নেয়া দরকার। ঢেলে সাজানো দরকার পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকেই। পাশাপাশি নিজের সংস্কৃতিকে এবং ধর্মকে যুগপৎভাবে চর্চার মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার। চর্চা করা দরকার পরমত সহিষ্ণুতারও। আমার এই পোড়া দেশে হাজারও সমস্যা, কিন্তু সবচেয়ে বেশি সমস্যা বোধ করি লোভী মানুষের আধিক্য।

আগেও অনেকবার বলেছি, কেবল ভয় দেখিয়ে আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মৌলবাদ বা জঙ্গী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মৌলবাদ মানসিকতাকে পাশ না কাটিয়ে বরং মোকাবেলা করা দরকার। নইলে, জাতীয় সঙ্গীতকে হিন্দু গান ভাববে, সেতার বাদক শিক্ষককে মেরে ফেলবে, সাংস্কৃতিক চর্চার গলা টিপে ধরতে চাইবে, পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু লেখকদের লেখা বাতিলের দাবী করবে, চারুকলাকে অশ্লীল বলবে, বৈশাখ পালন নিয়ে ধর্মকে টেনে আনবে  – এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.