আমরা কি বাই-স্ট্যান্ডার সিন্ড্রোম মুক্ত?

কাশফি জামান শ্যামা:

শুরুটা বাইবেলে বর্ণিত একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি, একবার এক ইহুদি ব্যক্তি ডাকাতের হাতে প্রচণ্ড মারধরের শিকার হয়।অনেক পথচারী তার পাশ কাটিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত এক পতিত-জনের সাহায্যে তার প্রাণ রক্ষা পায়। গল্পের ছলে যিশু খ্রিস্টের উপদেশ ছিল বন্ধু, উপকারি মানুষকে চিনতে পারা। কিন্তু আফসোস, সত্যিকার জীবনে এমন উপকার করতে আসা মানুষ ক্রমশঃই হ্রাস পাচ্ছে!

মানুষ কখনো উদাসীনতার বশে, কখনো বা শুধুই নিজেকে ঝামেলা থেকে সরিয়ে রাখার মানসিকতা নিয়ে অথবা নিছকই জনপ্রিয়তা পাবার জন্য অনেক বড় ধরনের অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। এমন দৃষ্টান্ত আজ অসংখ্য, যেখানে হাজারো মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব পিষ্ট হয়েছে বারংবার, কিন্তু কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি। 

সাইকোলজি’তে এর একটা বিশেষ নাম আছে, “বাই-স্ট্যান্ডার এফেক্ট “( By-Stander Effect)। অর্থাৎ কোথাও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, সবাই দেখছে, কিন্তু কেউ সাহায্যার্থে এগিয়ে আসছেন না। ১৯৬৪ সালের ১৩ মার্চ ‘কিটি জেনোভেসের’ মার্ডার কেস’টি সাইকোলজিতে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

কেটি জেনোবেস তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষারত ছিলো। সে তখন অফিস থেকে বাসা ফিরছিলো। সে সময় মোশেলে নামের এক যুবক তাকে ফলো করে এবং পিছু নেয়। ৮২-অস্টিন স্ট্রিটের অদূরে গাড়ি পার্ক করে কেটি জেনোভেস যখন তার গার্ডেনস এপার্টমেন্ট এর দিকে হেঁটে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনি মোশেলে তাকে পিছন থেকে চাপাতি দিয়ে একের পর আঘাত করে। কেটি তখন নিজেকে বাঁচাতে চিৎকার করতে থাকে। প্রায় ১০/১৫ মিনিট যাবৎ সে মোসেলের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে হেল্প, হেল্প বলে চিৎকার করছিলো কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখন কেউ আসেনি তাকে উদ্ধার করতে, যদিও তখন সেখানে অনেক লোক উপস্থিত ছিলো। ১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে নিজ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এভাবে এক তরুণীকে প্রকাশ্যে উপুর্যুপরি ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে হত্যার ঘটনাটি ছিল ওই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর একটি।
কেন সেটি এত আলোচিত? কারণ The New York Times উল্লেখ করেছিল যে, ওই সময়ে ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিল প্রায় ৩৭-৩৮ জনের মতো, যাদের কেউ ওই অসহায় তরুণীকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেনি। এরপর থেকেই এই ঘটনা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়। কেন সাধারণত জনাকীর্ণ একটি জায়গায় কেউ বিপদে পড়লে আশেপাশের কেউ সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে না? 
বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্টরা। দীর্ঘ গবেষণা ও উপস্থিত সকলের রিএকশন এনালাইসিস করে তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন, “ডিফিউশন অব রেসপনসিবিলিটি”র জন্যে এধরনের কোন আকস্মিক ঘটনার শিকারে পতিত ভিকটিমকে সাধারণত কেউ সাহায্য করতে আসে না। পরবর্তিতে কেটি জেনোভেস এর নামেই আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন এই ডিফিউশন অব রেসপনসিবিলিটি’র নাম দেন “জেনোভেস সিনড্রোম”। আমেরিকার আদালতে মোশেলের ফাঁসির রায় হয়। ফাঁসির রায় শুনে বিরক্তি প্রকাশ করে মোশেলে বলেছিল, আমার একটা মেয়ে মারতে ইচ্ছা করেছিল শুধু!!!
২০০৬ এ “ইলান হালিমি” নামের ৩৪ বছরের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ফ্রেঞ্চ যুবক’টি প্রকাশ্য দিবালোকে একদল মরোক্কান দূস্কৃতিকারির হাতে কিডন্যাপড হন। পরবর্তী ২৪ দিন বন্দী অবস্থায় নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে মারা যান। অন্তত ১০টি পরিবার জানতে এবং বুঝতে পারছিলো প্রতিবেশি এক বাসায় মারাত্মক কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, কিন্তু কেউ পুলিশকে কল করেননি। ঘৃণ্য অপরাধে জড়িত অন্তত চারজনের বাবা বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানতেন অপরাধ হচ্ছে, তারাও বাধা দেয়া বা ভিকটিমকে সাহায্য করার কোনরুপ চেষ্টা করেননি।
এটা সোশ্যাল ডিফিউশন অফ রেসপন্সিবিলিটির অন্যতম উদাহরণ।
এ তালিকায় সর্বাধিক আলোচিত সংযোজন ‘ রিচমন্ড হাই স্কুল ইন্সিডেন্ট’। ১৫ বছরের কিশোরী মেয়েটি স্কুলের জিমনেশিয়াম এ প্রায় ১০ জন অমানুষের হাতে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়। ভাবার বিষয় যে, প্রায় শ খানেক স্টুডেন্টের উপস্থিতিতে এই পাশবিকতা চললেও কেউ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ তো দূরে থাক, বরং মোবাইল, ট্যাবে ভিডিও করে নিয়েছিল। উপস্থিত একজন পরে বলেছিল, ভিডিও করবো না কেন, এমন লাইভ দেখার সুযোগ কি বার বার আসে!!!
নাম অপ্রকাশ্য মেয়েটি আজও ট্রমায় আছে, সাধারণ বাতাসের আওয়াজেও ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। 

এতো গেল দূর-দেশের কয়েকটি উদাহরণ। আমরা কি বাই-স্ট্যান্ডার সিন্ড্রোম মুক্ত? আমরা বুঝি পরিচিত, অপরিচিত সবার বিপদে সব ভুলে ছুটে যাই?
না ….
সম্ভবত পাশের বাসায় কে থাকে আমরা আজ সেই ধারণাও রাখি না, রাস্তা বা অজানা কাউকে সাহায্য তো অনেক দূরের বিষয়।
বর্তমান সময়ে চলমান চাঞ্চল্যকর বিচারাধীন মামলার অন্যতম একটি হচ্ছে সিলেটের এমসি কলেজ প্রাঙ্গনে বদরুল নামের এক ছাত্রনেতা কর্তৃক খাদিজা নামের অনার্স পড়ুয়া এক তরুণীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা চেষ্টার মামলাটি। অচিরেই হয়তো ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া খাদিজা এর ন্যায় বিচার পাবে।

ঘটনার পর দৈবক্রমে রেকর্ড করা ভিডিও ফুটেজটির মাধ্যমে বদরুলকে সনাক্ত করা হয়। আমি ঐ ফুটেজটি বেশ কয়েক বার দেখেছি। আমি বদরুলের মুভমেন্ট, আশপাশ প্রত্যক্ষকারী সহপাঠীদের প্রতিক্রিয়া, পুলিশের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ের মনস্তাত্মিক দিকগুলো পর্যালোচনা করার জন্যই ফুটেজটি বার বার দেখি। আমি ধন্যবাদ দেই তাকে, যে দৈবক্রমে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে দৃশ্যটি সাহসিকতার সাথে ভিডিও করে। কেননা এর মাধ্যমে আমরা বদরুলকে দ্রুত সনাক্ত করি, নাহলে হয়তো ঘটনাটি নানান মুখরোচক কল্পকাহিনীর জন্ম দিত।
যা হোক বদরুলের কোপানোর স্টাইল ও বডি ল্যাংগুয়েজ দেখলে বুঝা যায়, সে কোপানিতে সিদ্ধহস্ত। কুপিয়ে তার অভ্যাস আছে। পরে প্রমাণ পাওয়া যায়, বদরুল আগেও একবার খাদিজাকে দা নিয়ে কোপানো র জন্য তার গ্রামের বাড়ি যায় এবং সে সময় সে ধরা খায় ও গণপিটুনি খায়। সে যাত্রায় খাদিজা বেঁচে যায়। 
অনেকে ভিডিও দেখে প্রশ্ন করেন, এতো সহপাঠী থাকতে কেনো কোন একজন এগিয়ে এলো না! এগিয়ে আসলে হয়তো এতোটা জখম খাদিজার হতো না। বলে রাখি, খাদিজার যে হেড ইনজুরি বা ব্রেইন ইনজুরি হয়েছে, তা থেকে তার ফিরে আসাটা অলৌকিক, বেঁচে থাকাটাও অলৌকিক। এই অলৌকিক ঘটনার নেপথ্যে প্রথমত মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, দ্বিতীয়ত দ্রুত চিকিৎসা দানকারী সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের নিউরো-সার্জন’ রা। 
যাই হোক, কেন এতো মানুষ থাকতে একটা মানুষও তখন এই অসহায় তরুণীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি? এ প্রশ্নটি অবান্তর এবং অজ্ঞতাবশত। কেউ খাদিজাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি, কারণ এটাই তখনকার জন্য স্বাভাবিক। এটাই সোশ্যাল সাইকোলজি। উপস্থিত সকলের মাঝে যে সাইকোলজি কাজ করছিলো, তা হলো, “ডিফিউশন অব রেসপনসিবিলিটি” যা মনোবিজ্ঞানী বা সাইকিয়াট্রিস্টদের ভাষায় “জেনোভেস সিনড্রোম” নামে পরিচিত।
উত্তরার গ্যাং ওয়ারের শিকার সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেটি প্রকাশ্য দিবালোকে অগনিত মানুষের চোখের সামনে হত্যার শিকার হয়, অনেকের মোবাইলের ভিডিও চিত্র পরে ইন্টারনেটে ভাইরাল হলেও তৎক্ষণাৎ কেউই বাচ্চাটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি।
রাকিব’কে মেরে, বেঁধে, কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে মারা হয়েছিল, প্রকাশ্যে, অনেক মানুষের মাঝে। এই ঘটনা বাংলাদেশে সব মানুষকেই কষ্ট দিয়েছিল, ভাবতে বাধ্য করেছিল।
কোন ঘটনায় সামনে উপস্থিত সবার মাঝে জেনোভেস সিনড্রোম বা ডিফিউশন অব রেসপনসিবিলিটি কাজ যখন করে, তখন হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী সবাই ভাবেন, অন্য সবাই তো আছে সাহায্য করার জন্য, আমি কেন ঝামেলায় জড়াবো নিজেকে? বা “কেউ আগালে আমিও আগাবো” এরকম সিদ্ধান্তহীনতা। 
পরবর্তীতে সাইকিয়াট্রিস্টরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, “তুমি যত বেশি মানুষের সামনে বিপদে পড়বে, তোমার সাহায্য পাবার সম্ভাবনা তত কম হবে”। আবার একই গবেষণায় ইন্টারেস্টিং আরেকটি বিষয় দেখা যায়, “আকস্মিক বিপদে যত কম মানুষ সামনে থাকবে, তত বেশী সাহায্য পাবার সম্ভাবনা থাকে”। এর কারণ তখন সবার মধ্যে কাজ করে “ডিফিউশন অব রেসপনসিবিলিটি”। 
আমরা একটু চারপাশে তাকালেই এই নির্মম সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারবো। এরকম ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই আমাদের চারপাশে ঘটছে।

মর্মান্তিক একটা ঘটনা দিয়ে ফিচার’টা শেষ করতে চাই। ১৯৯৩ এ সাউথ আফ্রিকান ফটোগ্রাফার ‘কেভিন কার্টারের’ তোলা একটি বিশেষ ছবি বিশ্বময় আলোড়ন তুলেছিল। ছবিটিতে সাব- সাহারান অঞ্চলের দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত একটি বাচ্চার বেঁচে থাকার অদম্য চেষ্টা আর তার মৃত্যু প্রত্যাশী অপেক্ষমাণ শকুনের শিকার আর শিকারি’র দৃশ্য-পট মনে ঘা দেয়নি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। দুঃখের ব্যাপার হলো, কেভিন চাইলে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতেন, অন্তত পার্শ্ববর্তী শরণার্থী শিবিরে তাকে পৌঁছে দিতে পারতেন, কিন্তু আফসোস তিনি তা করেননি। স্থান ত্যাগ করলেও পরবর্তীতে এই কষ্টে তিনি আত্মহনন করেন।

সামাজিকভাবে প্রসূত সাইকোলজিক্যাল সমস্যাগুলা হয়তো একদিনে নির্মুল সম্ভব নয়, তবু বিবেক, মনন আর মানবিকতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা ভালো কিছুর উদাহরণ সৃষ্টি করার সামান্য চেষ্টা আমরা একবার হলেও করতে পারি। এই লেখায় সমাধান দেয়ার চেষ্টা করাও অমূলক, তবু সাধারণভাবে সবার জ্ঞাতের জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা রইলো। 
সবাইকে ভালবাসা।
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.