সুপ্রীতি ধর:
লেখার কিয়দংশ স্ট্যাটাস হিসেবে দিয়েছিলাম। ঘুম ভেঙে মনে হলো, লেখাটা থাকা উচিত, ফেসবুক থেকে হারিয়ে যাবে। তাই এই লেখার আশ্রয় নেয়া।
যেকোনো অ্যাপ্লিকেশন ফরম পূরণের সময় আমাকে পদে পদে আটকে যেতে হয়। প্রথমেই আটকাই ‘ধর্ম’ প্রশ্নে। বরাবরই আমি ‘মানবতা’ লিখতে চাই, কিন্তু অপশান থাকে না। যদি কোনো কারণে এই ঘরটি অপশনাল হয়, তাহলে নট অ্যাপ্লিকেবল দিয়ে পরের প্রশ্নে যাই।
এরপরে আসে ঠিকানা। স্থায়ী এবং অস্থায়ী। অস্থায়ীটা গড়গড় করে লিখে যাই, যখন যে ঠিকানায় থাকি। কীবোর্ডে হাত অবশ হয়ে আসে স্থায়ী ঠিকানার ক্ষেত্রে। কী লিখবো? আমার ঠিকানা আসলে নেই তো, কোথায় আমাকে খুঁজবে লোকজন? দু’দুটি বাড়ির ছবি মানসপটে ভেসে উঠে, যেখানে আমি ফ্রক পরে দৌড়ে বেড়াতাম, আমার সেই শিউলী ফুল গাছটা, এখনও কি আছে? থাকার কথা না। আমার সব স্মৃতিই মুছে দেয়া হয়েছে, ইচ্ছেতেই হোক, বা অনিচ্ছাতেই হোক! বাড়িটিও মুহূর্তেই হারিয়ে যায় স্মৃতি থেকে। দীর্ঘ অনভ্যাসে বাড়ির ছবি আবছা হয়ে আসে। অত:পর লিখি, ‘গৌরীপুর, ময়মনসিংহ’। যার দরকার সে খুঁজতে থাকুক। ছোট্ট মফস্বল শহরে ‘ধর’ পরিবার তো বেশি নেই, তাই কেউ ইচ্ছে করলেই পেয়ে যেতে পারে।
কিন্তু সমস্যাটা হবে পরে। ধরুন, খোঁজ পাওয়া গেল বাড়ির। এখন এই বাড়ির যারা বর্তমান বাসিন্দা, তারা তো আমাকে স্বীকার করে না, তারা মনেই করতে পারে না যে, এই বাড়িটাতে আমার নাড়ির টান আছে, এই বাড়িটাতেই আমার জন্ম হয়েছিল। সব বেদখল হয়ে গেছে আজ, সেইসাথে স্মৃতিগুলোও। আমার মায়ের সাথে আমার একটা ছবি ছিল। যতদিন মা ছিল, ছবিটাও ছিল। মা নেই, ছবিটার প্রথম ঠিকানা হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে আলনার জুতা রাখার স্থানটিতে। পরে সেখানেও এখন আছে কীনা, জানা নেই। কেউ ছবিটা আমাকে ফিরিয়ে দেয়ার কথাও ভাবেনি। যাকগে ….
এই ঠিকানা নিয়ে এখানে একটা গল্প আছে। আমার ছেলেমেয়ের পাসপোর্ট করার সময় এভাবেই (হাওয়ার উপরে) ঠিকানা লিখেছিলাম। পুলিশ ভেরিফিকেশনে সেই কাগজপত্র গৌরীপুর গিয়ে আটকে গেছিল। পুলিশের তো মাথা খারাপ, এরকম বিদঘুটে (বাংলা নাম) নামের কাকে খুঁজবে গৌরীপুরে, কে চিনে তাদের? প্রথমবার তাই ফেরত এসেছিল কাগজগুলো ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে।
দ্বিতীয়বার ঢাকা থেকে যখন আবার সেই কাগজপত্র যায় গৌরীপুর থানায়, পুলিশ একই কেস দেখে ফেলে রাখে কিছুদিন। যেদিন তারা আবারও ‘পাওয়া যায়নি’ লিখে পাঠিয়ে দেবে ডকুমেন্টগুলো, সেদিনই কী কারণে যেন আমার বড় দাদা থানায় যায়, তখন পুলিশ তাকে এই নামগুলো দেখালে সে আমার সাথে পুলিশের কথা বলিয়ে দেয় টেলিফোনে। তো, সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলাম, বাচ্চারা পাসপোর্ট পেয়েছিল। সে অনেকদিন আগের কথা অবশ্য।
তো, বলছিলাম ফরমের কথা।
আরেকটা জায়গায় আটকাই। তাহলো, ইমারজেন্সি ক্ষেত্রে কারও নাম, ঠিকানা দেয়া। প্রতিবার ভাবতে হয়, এবার কার নাম লিখবো? আমার যদি কিছু ঘটে, তাহলে ঠিক কাকে জানালে কারও (?) অসুবিধা হবে না, কেউ কি আমার জরুরি কোনো খবর জানার জন্য অপেক্ষা করে আছে? আমার কখন কী হলো, না হলো, তাতে কারই বা কী আসে যায়! আবার কেউ যদি অস্বস্তি বোধ করে! কতো সাত-পাঁচ যে ভাবি। হাতড়ে ফিরি মুখ, হাতড়ে ফিরি নাম। এক্ষেত্রেও স্থায়ী কোনো মানুষ নেই, যে আমার ইমারজেন্সি ‘ঠিকানা’ হতে পারে। একেক সময় একেকজনের দ্বারস্থ হই। তাদের ফোন দিয়ে বলি, শোন/ শোনো, তোর/তোমার নামটা দিচ্ছি ইমারজেন্সি কন্টাক্টে, যদি কিছু জানতে চায় বা জানাতে চায়, বলে দিও/জেনে নিও।
প্রয়োজনীয় মানুষ এর বড় অভাব এই জীবনে … যাদের এই মানুষগুলো আছে, যাদের ঠিকানা আছে, তাদের জীবনে ভালবাসাও আছে, তারা সৌভাগ্যবান। আমি তাদের ঈর্ষা করি। আবার তাদেরকেই বাঁচিয়ে দিয়ে, জিতিয়ে দিয়ে প্রতিদিন আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে।
ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়ানো নিয়েও কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি আমার! বেছে বেছে এমন স্কুলে গেছি, যেখানে তাদের নামের পাশে বাবার নাম লেখা হবে না, যেখানে তারা কোনো ধর্ম পড়বে না। স্কুল কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছেন আমার দাবি। ধর্ম পরীক্ষায় সবসময় একটা লামসাম নাম্বার তারা বসিয়ে দিতেন। তবুও আমি ওই দুটো বিষয়ে ভীষণভাবে অটল ছিলাম। যে লোকটির কোনো অবদান নেই সন্তান পালনে, আমি তার নাম কিছুতেই ব্যবহার করবো না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে সেই নাম নিয়ে ঝুলে থাকলেও অসুবিধা নেই, আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়বো না।
আর ধর্ম? হ্যাঁ, ছোটবেলাতেই আমি আমার বাচ্চাদের কোনো ধর্ম পড়তে দিতে রাজী না। ওরা জন্ম নিয়েছে আর দশটা বাচ্চার মতোই মানুষ হিসেবে, তাকে একটা ধর্মের আবরণ পরানো আমার কাজ না। বড় হয়ে একজন সৎ, নীতিবান, কারও ক্ষতি না করা, দুর্নীতিবাজ না হওয়ার পরও যদি তার একটা আলাদা ধর্মীয় আইডেন্টিটির প্রয়োজন হয়ই, তবে সে নিজেই ঠিক করুক কোনটা নেবে। যেকোনো ধর্ম সে নিতে পারে, এই স্বাধীনতা তাদের আছে। চাইলে সবগুলোর মিশেলও ঘটাতে পারে। যা ইচ্ছে তাই করুক। কিন্তু আমি তাদের ধর্ম দেয়ার কেউ নই। শুধুমাত্র জন্মেছে বলেই ধর্ম কেন হবে তার?
এই যে ফরমে ধর্ম উল্লেখ না করার মতোন মানসিকতা, এই ঠিকানাবিহীন জীবন, এসবই একদিনে হয়নি আমার। পরতে পরতে পোড় খেতে খেতে হয়েছে। এক সহকর্মী একবার আমায় বলেছিল, ‘জীবনটাকে নিয়ে বড় বেশি এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলেছেন আপনি’। আসলেই তাই, বেশি বেশি হয়ে গেছে। এতোটা না হলেই ভালো ছিল।
আমার মেয়ে কোথাও ফরম পূরণ করতে গেলে দেখতাম, বাবার নামের জায়গাটা উহ্য রেখে আর সব পূরণ করে আমার দিকে ঠেলে দিতো, ভাবখানা এমন যে, ‘এটা তোমার জন্যই হয়েছে যে আজ নামটাও লিখতে পারি না’। কত করে বুঝিয়েছি, এটা জীবনেরই অংশ, এমনটি হতেই পারে যে কারও জীবনে। যা পরিবর্তনশীল, তাকে ধরে-বেঁধে রাখার তো কারণ দেখি না। ওরা বোঝেনি আমায়। আমাকে ঠিক পড়তে পারেনি। ওরা কষ্ট পেয়েছে জীবনে বাবার অস্তিত্ব নেই বলে, আর আমি কষ্ট পেয়েছি, ওরা এই কষ্টটুকু উৎরাতে পারেনি বলে। এমনও বলেছি, পৃথিবীতে কত মানুষের জন্ম হয় বাবার পরিচয় ছাড়াই, তারা কি বেঁচে থাকে না? ওরা আমার এসব কথার জন্য ক্ষমা করেনি কখনও, বরং আমাকে আরও তাচ্ছিল্য করেছে। ওদের সীমাহীন তাচ্ছিল্য নিয়েও তো আমি বাঁচি।
তাতে কী? আমি কি ভেঙে পড়েছি? না….একেবারেই না। আমি সবার মুখ মনে করে একটা কথাই ভাবি, হয় তোমরা আমার মতো নও, নয়তো আমি তোমাদের মতো নই। পার্থক্যটা এখানেই।