বয়সই কি বাঁচিয়ে দিল গোলাম আযমকে?

সুমন্দভাষিনী (উইমেন চ্যাপ্টার): বাহ্, কত সুন্দর দেখা গেল, গোলাম আযমের রায় হলো….। ৯১ বছর বয়সে ৯০ বছরের কারাদণ্ড প্রাপ্তি মুখের কথা না। সবার এমন সুযোগ হয় না। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা, ধর্ষণের জন্য একজন শতায়ু হতে পারে এবং তা নির্বিঘ্নে, তা কেবল এই দেশেই সম্ভব। গণহত্যার মূল নির্দেশক হয়েও যে কিনা বছরের পর ধরে আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, জেলে বসেও যার সেই জীবনের এতোটুকু ব্যত্যয় হয় না, তার শতায়ু হবে না তো কি আমার-তোমার মতো আমজনতার হবে?

তাহলে কি বলবো যে, বয়সই বাঁচিয়ে দিল গোলাম আযমকে? বয়স কি জীবনের সব পাপ-তাপ ধুয়ে-মুছে দেয়? হেফাজত নেতা আহমদ শফীর তো গোলাম আযমের চেয়েও দুবছর বেশি বয়স। কিন্তু এ বয়সেও কী সুন্দর ‘তেঁতুল বাণী’ দিয়ে যাচ্ছেন মহাসমারোহে, আর সেই ‘বাণী’ শুনে আপ্লুত হচ্ছেন লাখ লাখ ধর্মান্ধ মানুষ, সেকথা কি বিবেচনা করবে না কেউ? বয়স কি পাপ করতে বাধার সৃষ্টি করে কোথাও? যদি তা নাই করে, তবে বিচার কেন হতে পারবে না? শফী যদি লাখ লাখ মানুষকে ‘অধর্মের’ পথে টেনে নিতে পারে এই বয়সেও, গোলাম আযম কেন ফাঁসির দড়ি পরতে পারবে না, আমাকে কেউ বোঝাবে?

একাত্তরে বাবাকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ভারতই ছিল আমাদের গন্তব্য। শরণার্থী শিবিরের মোটা চালের ভাত তখন একটি ছোট শিশুর মুখে রচেনি। শিশুটির মায়ের তখন একদিকে স্বামী হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে বাস্তব ছিল ক্ষুধার্ত শিশুটির কান্না। অথচ জেলখানায় বসে সেই শিশুটিরই পিতাকে হত্যাকারী চিকন চালের ভাত খায়! ঈশ্বরের কী অপূর্ব লীলা!

শুধু তাই নয়। ৪২ বছর পর আবারও দেশটির স্বাধীনতাকেই যেন লাঞ্ছিত করা হলো এই রায়ের মধ্য দিয়ে। এ যেন মানচিত্র আর পতাকাকেই অবমাননা করা। দীর্ঘ নয় মাস পেটে ধরার পর যে স্বাধীনতাকে প্রসব করেছিল বীর বাঙালী, তাদের সাথে স্রেফ জুয়া খেলা হলো।
মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় গোলাম আযমের রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারাও। দেখানোটাই স্বাভাবিক। তারা যুদ্ধ করেছেন, তারা জানেন জীবনের কি ঝুঁকি নিয়ে তারা তখন ঘরে-বাইরে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলও এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। একটি অনলাইন পত্রিকাকে একাত্তরে দুই নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেন বলেছেন, “এই রায়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি আহত, দুঃখিত এবং লজ্জিত। গোলাম আযম ছিল একাত্তরের মূল খলনায়ক। একাত্তরে এই পরিমাণ হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণের মূল নীল নকশা ছিল গোলাম আযমের। তার ফাঁসি হলো না। এই রায় আমরা মানি না।”

যদি বলি যে, এটা প্রহসনের রায় হয়েছে, তাহলে ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করা হয় মোটা দাগে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল কোন আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে এই রায় দিল তা বোধগম্য নয় মোটেও। দেশের সাধারণ জনগণকে বলির পাঁঠা বানিয়ে এ ধরনের বাণিজ্য দেশদ্রোহিতার শামিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এই মূলো ঝুলিয়ে দেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল সরকার নির্বাচনে। এই কি সেই বিচার তাহলে? এই প্রজন্মকে তো একপ্রকার কাঠগড়ায়ই দাঁড় করানো হলো এই রায় দিয়ে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন হওয়ার পর জনগণ তাতে আঁতাতের গন্ধ পাচ্ছিল, ফলে তাৎক্ষণিকভাবে জনগণ তার বিরোধিতা করায় গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু তাকেও নানা প্রলোভনে করায়ত্ত করতে এতোটুকু সময় নেয়নি ক্ষমতাসীন দল। গণজাগরণও তখন সেই ভুলটা করলো, ধরা দিল তাদের পরিকল্পনায়, যার মাশুল আজ গুণতে হলো প্রগতিশীলদের।

আমি বলবো যে, খুবই মোক্ষম একটা সময় বেছে নেয়া হয়েছে এই রায় ঘোষণার জন্য। গোলাম আযমের মতোন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ঘোষণা করা হলো রমজান মাসে, যাতে আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে রমজান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সবার কাছে। রোজার মধ্যে মানুষ আর গৃহত্যাগী হবে না এটা নিশ্চিত জেনেই সময়টা নির্বাচন করা হয়েছে। কিন্তু কেন?

গোলাম আযমের রায়ের পর যখন বিএনপির কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না প্রতিক্রিয়া নেয়ার, তখনই কালক্ষেপন না করে সন্তোষ প্রকাশ করে বসলো আওয়ামী লীগ।

আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘সমস্ত দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক মান ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে বিচার হয়েছে। আমার মনে হয়, এটা দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। বয়স বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া আন্তর্জাতিক রীতি বলে মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা সবাইকে মানতে হবে।’

আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আদালতের রায়ে তাঁকে একাত্তরের ঘাতকদের শিরোমণি বলা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বয়স বিবেচনায় তাঁকে ৯০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। এতে অসন্তুষ্ট হওয়ার কিছু দেখছি না।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, জামায়াতে ইসলামিকে খুশি করতে পারলে কাদের ভোটের বাজার বাড়বে? আওয়ামী সরকার যদি মনে করে যে, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে পরাজয়ের রেশ মুছে দিতে পারবে এই রায়ের পর, মস্তবড় ভুল করবে তারা। এই জামাতিরা কখনও আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল কোনদিন? নাকি দেবে ভবিষ্যতে? তরুণ প্রজন্মকে পাশে পেয়েছিল এই সরকার। আজ তাদেরকেই হারাতে বসেছে। কেউ আর ভোটের ‘বলি’ হতে চাইবে না আমি নিশ্চিত। কিছুতেই না। এইদেশ গুটিকয়েক নষ্ট রাজনীতিকের নয়, এইদেশ সবার। এটা যারা না বুঝবে, এবার থেকে রাজনীতির দাবার গুটি তাদের জন্য উল্টো পথেই চলবে।

নতুন প্রজন্মের মুখ আমার চেনা। তাদের চরিত্রও আমার জানা। এরা একবার বাঁকলে আর তাদের সোজা করা সহজ হবে না। আমরা নেহায়েতই বেকুব জনগণ। আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, এটা এই সরকার ভালই জানে। আর জানে বলেই তারা আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়ার সাহস পায়।
তবে এটাই সুযোগ আমাদের সামনে। অনেক হয়েছে, আমরা অনেক হারিয়েছি, তারপরও মুখ বুজে সয়ে গেছিলাম। ভবিষ্যত যদি আমাদেরই নির্ধারণ করতে হয়, তবে আসুন, আমরা রাজনীতিকে ‘না’ বলি, ভোটকে ‘না’ বলি।

তবে এখানে একটা চুপি চুপি বলে রাখি, এই রায়ের মধ্য দিয়ে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে ধর্মীয় দিক থেকে সংখ্যালঘু পরিবারগুলো। দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পর যে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল, এবারও যদি তাই হতো, তবে সীমান্তের কাঁটাতারের দিকে মানুষের কাফেলা কেবলই দীর্ঘায়িত হতো, হাতছাড়া হয়ে যেত ভিটেমাটি, জন্ম-জন্মান্তরের পরিচয়টুকুও। সেদিক থেকে গোলাম আযমের বয়সটা একটা ফ্যাক্টরই বটে!

এতো বছর যে ব্যক্তিকে সব সরকারই সমীহ করে চললো, জামাই আদরে রাখলো, এমনকি জেলে বসেও যে ব্যক্তি চিকন চালের ভাত খায়, ৯১ বছর বয়সেও যে ব্যক্তির রোশনাই ঝরে ঝরে পড়ে, তাকে শেষ বয়সে দড়িতে ঝুলাতে অবশ্যই খটকা লাগার কথা, সে সরকারই হোক, আর ট্রাইব্যুনালই হোক….।

শেয়ার করুন:

আপনারা মনে করেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে এ বিচার হত? যদি তাই হয়, নামুন মাঠে দশ লাখ মানুষ , রায় বদলাতে ও পারে । মনে রাখবেন , দশ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে…।

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.