পাহাড়ে পাহাড়ে কান্নারাই একমাত্র সত্যি

দিলশানা পারুল:

ভদ্রলোক খীসা! আমাকে হাসতে হাসতে বলছিলোআমাকে আপনি জোর করে বাঙালী বানাতে চাইলে বানাতেই পারেন আমার কিছু করার নাই কিন্তু বলার তো আছে বটেই কী দেখে আমাকে আপনার বাঙালী মনে হলো? আমার চেহারা আপনার মতো? না আমার ভাষা আপনার মতো? না আমার সংস্কৃতি আপনার মতো? তাহলে আপনি আমাকে বাঙালী বলবেন কেন?

তবে এইটা ঠিক আমি বাংলাদেশী, আমার পাসপোর্ট বাংলাদেশী, আমার বাপদাদা চৌদ্দ পুরুষ এই ভূখণ্ডেরই মানুষ, জন্মসূত্রে আমি অবশ্যই বাংলাদেশী আমরা বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বাঙালী না, এইটা মানতে আপনার সমস্যটা কোথায়? ”

তিনি যে বাংলাদেশি এবং এইটা নিয়ে ভদ্রলোকের মধ্যে কোন সংশয় আছে বলে আমার মনে হলো না আমি সরাসরিই তাকে প্রশ্ন করে বসলাম, কিন্তু আমি তো শুনেছি আপনারা স্বাধীনতা চান? নিজেদের ভূখণ্ড স্বাধীন করতে চান? তিনি বললেন, কী অদ্ভূত কথা? এইটা আপনি কোথায় শুনেছেন বলেন তো? স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের যতটুকু অধিকার প্রাপ্য আমরা শুধু সেইটুকুই চেয়েছি, তার বেশি তো চাই না!

আমি বললাম, তো আপনাদের অধিকার কোথায় খর্ব হচ্ছে? অসুবিধাটা কোথায়? তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,সারা বাংলাদেশে যত আর্মি আছে, শুধু পার্বত্য অঞ্চলেই তার দুইতৃতীয়াংশ থাকে, কেন?“ এই তথ্য অবশ্য আমি আসলেই জানতাম না তিনি বললেন, জ্যোতিদাকে দেখলেন না? ওনারা তো উদ্বাস্তু তিন তিন বার ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়েছে কেন? গত ২০ বছর হলো চেষ্টা করছে বাপের ভিটায় উঠতে পারেনি, কেন? দলে দলে লোকজনকে তো রংপুর থেকে সিলেটে মাইগ্রেট করানো হয় না, এইখানে হয় কেন?

তিনি আমাকে অদ্ভুত এক পাহাড়ী সমাজ ব্যবস্থার গল্প শোনালেন, যে সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন আমরা দেখি, এই দেশেই যে এমন হতে পারে আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি পাহারে কোন টিলায় যদি কেউ চাষ করে তাহলে পরবর্তী তিন বছরের জন্য সেই টিলায় চাষ করার অধিকার তার জন্মে যায় ওই টিলায় আর কেউ চাষ করে না তিন বছর পর কেউ যদি ওই টিলায় চাষ করতে চায়, তবে তার অনুমতি নিয়ে তারপর চাষ করে

কী অ্দভুত সামাজিক সম্পত্তির উদাহরণ! এতোদিন শুধু বইয়ে পড়েছি সম্পত্তির মালিকানা সমাজের, সেটা যে কীভাবে হতে পারে কোনো ধারণাই ছিলো না পাহাড়ে আপনার আমার শেখা অংকও ভুল হয়ে যায়, জানেন? ওখানে কলার কুড়ি হয় কয়টায় বলেন তো? বাঙালীদের কলার কুড়ি হয় ২০ টায়, আর পাহাড়িদের ২৮ টায় ডিমের কুড়ি ২৪ টায় আমের শতক ১২৮! কী অদ্ভুত না? এইগুলা কিন্তু আমার বাঙালী কলিগদের কাছে শুনেছি আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম, মানে? কেন? আমার কলিগ বললো, পচনশীল জিনিস ওরা সবসময় আপনাকে কিছু বেশি দেবে, কারণ বাড়ি যেতে যেতে যদি ওটা পচে যায়! আমি বললাম, কী বোকা! ভদ্রলোক বললো, আমাদের কাছে বোকা, কারণ আমরা তো চিটিং অভ্যস্ত হয়ে গেছি! আসলে তো সৎ! আমি শুধু একটু বোকা বনে তাকিয়ে রইলাম!

পাহাড়ে যে হত্যাযজ্ঞ ঘটে সেটা রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ। অনেক না জানা ঘটনার পিছনের ঘটনাগুলো জানার জন্য নেট ঘাটছিলাম। ২০১২ সালের একটা গবেষণা পেপার পেয়েছি, “ international work group for indigenous affair (IWIGA) ” এর । সেই পেপার অনুযায়ী ২০১২ তে র্পাবত্য অঞ্চলে সশস্ত্র সেনা ছিলো  ৪০,০০০, সশস্ত্র বিজিবি সদস্য ১০,০০০ এবং সশস্ত্র পুলিশ এবং আনসার আছে ১০,০০০। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী র্পাবত্য অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ১৩,৩০,০০০। তার মানে প্রতি ৪০ জনের জন্য বরাদ্দ আছে একজন করে সশস্ত্র পাহারাদার। এই হিসাব আমার না। ওই গবেষণা পেপারে লিখা।

পাহাড়ের কতগুলো হত্যাকাণ্ডের গল্প শুনবেন আপনি? লোগাং? বাঘাইছরি? মহালছরি? রামগড়?     

বাঙালী বাংলাদেশী! হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান! ঢাকা, খুলনা, রংপুর কিংবা বরিশাল! আপনি লোগাং হত্যাকাণ্ড সমন্ধে জানেন? আপনি কি কল্পনা চাকমা কিংবা রমেল চাকমার নাম শুনেছেন? খাগরাছড়ি হয়ে বান্দরবন, রাঙামাটি! কত সহস্র পাহাড়ির কান্না মিশে আছে জানেন কিনা?

অথচ এই পাহাড় আমারও পাহাড়এই পাহাড়ে আমরা বাঙালীরা শুধু ছুটি কাটাতে যাই। সাজেক এর ভ্যালীতে সকালের চায়ের সাথে সূর্যোদয়আহা সেনাবাহিনী প্রহরায় কী সুন্দর অসাধারণ ছুটি! রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজে সেনাবাহিনী প্রহরায় কী সুন্দর হানিমুন! পাহাড় তোমায় আমি ভালোবাসি, কিন্তু মানুষগুলোকে নয়!

বিষয়টা কি এরকম? এই দেশেরই দক্ষিণে বছরের পর বছর ধরে এই ভূখণ্ডেই জন্ম নেয়া মানুষগুলো এই দেশেরই পাহারাদার দ্বারা খুন হবে, অপহৃত হবে, ধর্ষণের শিকার হবে, গ্রাম ছাড়া হবে, দেশ ছাড়া হবে! আমরা সমতলের বাংলাদেশিরা এই নিয়ে টুঁ শব্দটিও করবো না? কারণ ওরা আমাদের জাতি ভাই না বলে? কিন্তু দেশি ভাই তো বটে!

সংজ্ঞা অনুযায়ী সেনাবাহিনী হচ্ছে এই দেশের পাহারাদার, মালিক তো না! কিন্তু হাবভাবেতো মনে হয় উহারাই দেশের মালিক আর আমরা ব্লাডি সিভিলিয়ান! তাহারা সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে! সিএইচটিতে তারা আছে পাহারা দিতে তাইতো! তাহলে প্রত্যেকটা টুরিজম ব্যবসা তারা নিয়ন্ত্রণ করে কেন? ওইখানে কোন অনুষ্ঠান করতে গেলেও তাদের অুনমতি ছাড়া আপনি পারবেন না কেন? তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গাছের পাতাও পড়ে না! সেটেলার বাঙালী আর পাহাড়ি কোন্দল পুরোটাই সেনাবাহিনীর তৈরি করা! তাহলে তার প্রতিকারে কেউ ভূমিকা রাখে না কেন? কল্পনা চাকমা কই? লোগাং হত্যাকাণ্ডের জন্য কেউ কি ক্ষমা চেয়েছে কারো কাছে? একটা গ্রাম ধরে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো, ২৪ বছরে কোন তদন্ত বা কোন কিছু হয়েছে? রমেল এর মতো নিরীহ একটা ছেলেকে মেরে ফেলে লাশ পুড়িয়ে দিলো, এত সাহস সেনাবাহিনী পায় কোথায়?

কারণ স্বীকার করেন আর নাই করেন, ওরাই এই দেশের মালিক আর আমরা ব্লাডি সিভিলিয়ান! কারণ আমরা সেনাবাহিনীরে যমের মতো ডরাই! প্রত্যেকটা সরকার সেনাবাহিনীকে তোয়াজ করে চলেকারণ আমাদের চোখের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর জিয়াউর রহমানের লাশ এখনও জীবন্ত!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.