নারী জাগরণের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র- নাসরীন হক

সামিয়া আহমেদ:
নাসরীন হক বাঙালি নারী জাগরণের ক্ষেত্রে এমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যা অতুলনীয়। তাঁর বিশ্বাস, মেধা, সহিষ্ণুতা যেমন আমাদের করেছে সমৃদ্ধশালী, ঠিক তেমনি নারী উন্নয়নে ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনায় তিনি ছিলেন এক বিশাল স্থপতি। আজ থেকে ১১ বছর আগের এইদিনে ২৪ শে এপ্রিল ২০০৬ এর আকস্মিক দুর্ঘটনায় নিভে গেছে নাসরীন হকের প্রাণ প্রদীপ, যা কিনা পতন ঘটিয়েছে বাংলাদেশের নারী জাগরণের এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের। থমকে গেছে প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ।
নাসরীন হক স্বপ্ন দেখতেন এমন একটি সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার, যেখানে পিছিয়ে পড়া নারীকুল পাবে তার ন্যায্য অধিকার। নাসরীনের সাথে আমার পরিচয় ঘটে ২০০১ সনে, যখন আমি কাজ করি কেয়ার বাংলাদেশে। পরিচিত হবার উপলক্ষ্যটি ছিল, “৫ বছর কম বয়সী শিশুদের পুষ্টিহীনতা” বিষয়ক একটি গবেষণা কাজের আলোচনায়। তখনকার পরিচয়টা ছিল খুব স্বল্প সময়ের জন্য। স্বপ্নেও ভাবিনি এই মানুষটি আমার জীবনে আসবে এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব হিসাবে এবং হয়ে দাঁড়াবে আমার রোল মডেল।
এরপর দেখা ২০০৩ সালের জানুয়ারীতে একশনএইড বাংলাদেশের অফিস চত্বরে। এলোমেলো ঘন চুলের মৃদুভাষী এক নারী, যার কথোপকথনের ঢং যেকোনো মানুষের মনকে একবার হলেও দোলা দেয়। প্রথমে কিছুটা শঙ্কায়ে ছিলাম এই ভেবে যে নারী নেতৃত্বে একশনএইড এর মতো একটি ভিন্ন আঙ্গিকের এন জি ও কিভাবে এগিয়ে যাবে। খুব তাড়াতাড়ি তিনি প্রমাণ করলেন নারীও হতে পারে নেতৃত্বের শক্ত কাণ্ডারি।
আমার কাজের অভিজ্ঞতা এনজিও প্রোগ্রাম মনিটরিং ও ইভালূয়েশন এ। অথচ নাসরীন আমার মধ্যে ক্রমান্বয়ে জাগিয়ে তোলেন নারী উন্নয়নের কাজের এক বিশেষ স্পৃহা। তাঁর নারী জাগরণের হাজার স্বপ্নের মাঝে একটি স্বপ্ন ছিল এদেশের নারী কারাবন্দীদের নিয়ে কাজ করার। এমনিতেই নারীরা অবহেলিত, নির্যাতিত এবং নিপীড়িত, আর যে নারী একটি ভুলের জন্য কারাবাসে গিয়েছে, সে তো আরও বেশী মাত্রায় সমাজ দ্বারা ধিকৃত।
নাসরীন হকের নেতৃত্বে আমরা একশনএইড এর একটি দল তৈরি করি একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা। ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানার ২০০ নারী হাজতি কারাবন্দীদের নিয়ে কাজ করবো এই উদ্দেশ্যে যে – এরা যেন এদের কারাবাস শেষে গড়ে তুলতে পারে এমন একটি জীবন, যা তাদেরকে সহায়তা করবে সমস্যাহীনভাবে সামনে এগিয়ে যেতে। আমি বিশেষভাবে দায়িত্ব পাই এই প্রকল্পটির সরকারী অনুমোদন পাবার ক্ষেত্রে যাবতীয় অফিসিয়াল যোগাযোগের কাজটিতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়েও শেষ পর্যন্ত আমরা কাজটি শুরু করতে পারিনি বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। অথচ এই কাজটি শুরু করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে বিভিন্ন বৈঠক করার ক্ষেত্রে নাসরীন হক সময় দিতে কখনই কার্পণ্যবোধ করেননি। আর তখনই অনুধাবন করেছি তার মেধার ব্যাপকতা, হৃদয়ের মাহাত্ম্য এবং অপরিসীম সহিষ্ণুতা।
নাসরীন হকের আরেকটি স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের এসিডদগ্ধ মেয়েদের জন্য কিছু করা। বাংলাদেশের অন্যতম এসিড সন্ত্রাসপ্রবণ অঞ্চল সাতক্ষীরায় এসিড সন্ত্রাস দমনের স্বপ্ন নিয়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একটি পাইলট প্রকল্পের। সেই সূত্রে আমার প্রথম সুযোগ হয় এসিডদগ্ধ কিছু নারী পুরুষের সাথে পরিচিত হবার। এটা ছিল আমার জীবনে একেবারে ভিন্নধর্মী একটি অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক যুগের ভিন্নধর্মী বর্বরতার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ। তার পাশাপাশি দেখলাম নাসরীন হক কী প্রগাঢ় ভালবাসা ও তীক্ষ্ণ মেধার সমন্বয়ে গড়ে তুলতে যাচ্ছেন একটি নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা, যা কিনা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়ে এসিড সন্ত্রাস দমনের একটি বিশাল হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা এবং এলাকার জনগণ সংগঠিত করার মাধ্যমে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল গড়ে তোলে এসিড সন্ত্রাস দমনের এক কঠোর দুর্গ। এটি একটি অত্যন্ত সফল প্রকল্পের রুপ ধারণ করে, যা কিনা একটি সফল মডেল হিসাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুকরণ করা সম্ভবপর হবে।
নাসরীনের প্রিয় ফুল কৃষ্ণচূড়া। কৃষ্ণচূড়ার উজ্জ্বল রং এর মত রাঙা ছিল তাঁর জীবন, ঠিক তেমনিভাবে রাঙিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন পরিবারের অবহেলিত নারীদের জীবন। নাসরীন বলতেন, হিমশৈলের দৃশ্যমান অংশের মতো নারী নির্যাতনের দৃশ্যমান অংশটি হচ্ছে – ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাস, হত্যা এমনকি আত্মহত্যা।
অথচ একজন নারীকে তখনই হত্যা করা হয় অথবা সে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, যখন সে তার প্রতিদিনের জীবনের মানসিক ও শারীরিক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে পারে না। আর প্রতিদিনের এই লাঞ্ছনা-গঞ্জনার চিত্র আমাদের কাছে কখনই দৃশ্যমান নয়, থাকে পর্দার অন্তরালে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি প্রতিদিনের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সামাজিক অপরাধ হিসাবে কখনই স্বীকৃত নয়। কিন্তু নাসরীন বিশ্বাস করতেন, আর চুপ করে থাকা নয়, এখন সময় এসেছে এধরনের অন্যায়কে সামাজিক অবিচার হিসাবে স্বীকৃতি দেবার। এই উদ্দেশ্যেই চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার উথলি ইউনিয়নের ৮ টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠে ব্রেভ প্রকল্প, যা পরিবারের প্রাত্যহিক নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার এক অবিশ্বাস্য প্রয়াস।
তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাংলাদেশের পারিবারিক পর্যায়ে নারী নির্যাতন বিরোধী একটি আদর্শ ইউনিয়ন হিসাবে “উথলি” পরিচিত হবে।
পাঠককুল, বুঝতেই পারছেন নাসরীন হক নামটি একটি সাহসিকতার প্রতীক, সমাজ প্রগতিশীলতার মাইল ফলক, এটি অনুপ্রেরণা এবং সর্বোপরি সমাজের অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের নির্ভরশীলতার ক্ষেত্র। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি যে আমার জীবনের চারটি বছর এই মহীয়সী নারীর বিশেষ সান্নিধ্যে কাটাতে পেরেছি।
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.