নারীর চলাফেরার গণ্ডি এবং জীব-জড়ের পার্থক্য

নাহিদ খান: 

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে কুলসুম ক্লাস সেভেনের বিজ্ঞান বইয়ে ‘জীব ও জড় এর মধ্যে পার্থক্য পড়ে। পড়ার পর মেয়েটা বিরাট ধন্দে পড়ে যায়। কুলসুম কি শিখেছে আসুন সেটা আগে দেখি, তারপর আমরা বের করার চেষ্টা করবো এই ছটফটে কিশোরীটি এমন বিভ্রান্ত হয়ে গেলো কেনো!

জীব
খাদ্য গ্রহণ করে
নড়াচড়া করে, চলাফেরা করে
বড় হয়, বৃদ্ধি ঘটে
সন্তান উৎপাদন করে
বর্জ্য ত্যাগ করে

জড়
খাদ্য গ্রহণ করে না
নড়াচড়া, চলাফেরা করে না
বড় হয় না, বৃদ্ধি ঘটে না
সন্তান উৎপাদন করে না
বর্জ্য ত্যাগ করে না

হয়েছে কি, আমাদের কুলসুম এই ‘জড়পদার্থ’ এর জায়গায় তার মা, বুবু এরকম আরকয়েকজন বাংলাদেশের মেয়েকে বসিয়ে উদভ্রান্ত হয়ে যায়!

তার মা মর্জিনা খাদ্য গ্রহণ করে না তা নয়, কিন্তু মেয়েমানুষ খায় কি না খায় সেটা কেউ খেয়াল রাখেনা। তাকে বরং না খাওয়ার জন্য উতসাহিত করা হয়। যে মেয়েমানুষ যতবেশি নিজে না খেয়ে স্বামী, সন্তান, আত্মীয়কে খাওয়াবে সে ততোই ভালো!

মা, বুবু ওরা নড়াচড়া, চলাফেরা করে যতটুকু গণ্ডি বেঁধে দেয়া আছে ততটুকুর মধ্যে। মা মর্জিনার জন্য সেটা রান্নাঘর অবধি, বোন জরিনার জন্য সেটা বাড়ির পাশের মাঠ, পুকুর, প্রতিবেশীর বাড়ি অবধি, শহরে থাকে যে ভাগ্যবান খালাতো বোন তার জন্য সেটা অফিস অবধি, কিন্তু মেয়েমানুষ নিজের ইচ্ছেয় খেয়ালখুশিমতো কোত্থাও যেতে পারেনা। কুলসুম জন্মেও সেটা দেখেনি।

বড় হয়, বৃদ্ধি ঘটে। কই কুলসুমের মা মর্জিনার তো বৃদ্ধি নাই। নিজের বাবা-মা’র সংসারে তার মতামত মূল্যহীন ছিল, স্বামীর কাছে সে তুচ্ছ, ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, কুলসুমের বড়ভাই, বোন তাদের বাবার পরামর্শ নেয়, মাকে পুঁছে না।

নিজের সন্তান উৎপাদন করে। সেটা অবশ্য করে, তবে না বুঝে, না জেনে, অনেক সময় নিজের অনিচ্ছায়। সন্তান আদৌ সে চায় কীনা, কখন চায় এই বিষয়ক পরামর্শ কেউ তার সাথে করে না। আর সে সন্তান তার নিজের কীনা কে জানে, কুলসুম শুনেছে সবাই বলে বাপের সন্তান!
এইযে জরিনাবুর যখন বিয়ের দুমাস পরেই বাচ্চা পেটে আসে সে ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, বারবার বলছিল ‘মা আমি কি তাইলে মইরা যামু’, সবাই তাকে কতো গালি দিল। দুলাভাই একটা থাপ্পড় মেরে বললো ‘আমার বাচ্চা যদি তুই ঠিকমতো না রাখস তোরে আমি দেখে নিব জরিনা’! আবার কুলসুমের ইশকুলের যে আপার বাচ্চা হয়না তাকে সবাই বলে অপয়া, বাঁজা মেয়েমানুষ। কুলসুম মনে মনে ভাবে, আপা হয়তো নিজেই বাচ্চাকাচ্চা চায়না। তেরো বছরের কুলসুম যেটা বোঝে, অন্য কেউ সেটা বোঝে বলে মনে হয়না!

বর্জ্য ত্যাগ করে। করতে হয়, জৈবিকভাবে, কিন্তু এটা যেনো এক বিরাট অন্যায় বা পাপ। পথেঘাটে, ইশকুলে বাথরুম চেপে রাখতে হয়। মাসিক লুকাতে হয়। মাসিকের কাপড় নোংরা পরিবেশে লুকিয়ে ধুতে হয়, অন্য কাপড়ের নীচে শুকাতে দিতে হয়। মেয়েরা তো এক্কেবারে নেহায়েত সম্ভব নয় যখন কেবল তখনই টয়লেটে যায়। পানি পর্যন্ত খায় ভয়ে ভয়ে…

তো আমাদের কুলসুম, অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে মেয়েমানুষ সম্ভবতঃ জড়পদার্থ!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.