ইমতিয়াজ মাহমুদ:
(১)
গোলাম আজম কী কী অপরাধ করেছিল সে কি কারো অজানা ছিল? না। এমনকি গোলাম আজম নিজেও কখনো সেটা অস্বীকার করেনি। আমরা গোলাম আজমের বিচার করেছি। দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের দল তার পক্ষে মামলা লড়েছে। প্রকাশ্য আদালতে বিচার হয়েছে। তার পক্ষে সাক্ষিরা সাক্ষ্য দিয়েছে। এরপর গিয়ে আদালত ওকে সাজা দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে সে আবার আপীলও করার সুযোগ পেয়েছে।
অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনাবলী সে অস্বীকার করেনি, নানারকম টেকনিক্যালিটির ফাঁক গলে সে বের হতে চেয়েছিল। মরার আগের দিন পর্যন্ত আমাদের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র তাকে চিকন চালের ভাত খাইয়েছে গুড়া মাছ, বড় মাছ মুরগির মাংস মুগ ডাল আচার আরও কী কী দিয়ে। সাথে আবার প্রতিদিন ওকে কয়েক চামচ করে অলিভ অয়েলও দিয়েছে প্রতিদিন।
আর গোলাম আজম যখন মরেছে ওর লাশ নিয়ে ওরা দুইদিন অপেক্ষা করেছে। সারাদেশ থেকে লোক জড়ো করেছে। এরপর বায়তুল মোকাররমে সমাবেশের মতো করে জানাজা পড়েছে। জানাজা থেকে শোভাযাত্রা করে লাশ নিয়ে গিয়ে দাফন ইত্যাদি করেছে। সেই কবর এখনো আছে। ওর আত্মীয় স্বজনরা সেখানে জেয়ারত করে। এই পুরো ব্যাপারটাই হয়েছে পুলিশি পাহারায়।
এই হচ্ছে একজন স্বীকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধীর সাথে আমাদের রাষ্ট্রের আচরণ। ভুলে যাবেন না, এই অপরাধ পৃথিবীর সর্বত্রই একটি ঘৃণিত অপরাধ হিসাবেই বিবেচিত।
আর আমার ছেলে রমেলের সাথে রাষ্ট্র কী আচরণ করেছে?
(২)
রমেল কোন অপরাধ করেছে বলে শুনিনি। শারীরিক সীমাবদ্ধতা ছিল, একটা চোখে ও দেখতে পেতো না। পাহাড়ের কোন এক অখ্যাত কলেজে পড়েছে, সেখান থেকে নান্যার চর এসেছে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে। নান্যার চরই ওর জন্যে শহর, সেখানে ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করে সে থাকতো। ঐ ঘরেই থাকে, পড়াশুনা করে, আর সময়মতো পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষা দেয়। সেদিন পরীক্ষা ছিল না বলে সে বাজারে গেছে কয়টা সবজি কিনবে বলে।
কোথায় কোন এক সেটেলার মোটর সাইকেলওয়ালা মরেছে, তার জন্যে নান্যার চরের সব আর্মি পুলিশ মাঠে নেমেছে পাহাড়ি আদিবাসীদেরকে শায়েস্তা করবে। এক মেজর সাহেবের নেতৃত্বে একদল মিলিটারি রমেলকে ধরেছে। ধরে সেইখানেই মারা শুরু করেছে। মেরে ওর হাত-পা ভেঙে দিয়েছে সবার সামনেই। কিশোর ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদছিল। ওদের কাছে কাকুতি মিনতি জানাচ্ছিল, আমি কিছু করিনি, আমি কিছু জানি না, আমি নান্যার চর এসেছি শুধু পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে। আমাকে বাঁচান, আমাকে ছেড়ে দেন।
আমাদের বীর্যবান সাহসী সেনাবাহিনীর বীর অফিসারের মন ভরেনি। বিশাল সাহসিকতার সাথে ওরা এক চোখে দেখতে পায় না এইরকম একটি পুঁচকে কিশোর ছেলেকে, তাও আবার মার খেয়ে হাত-পা ভাঙা, ওকে ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিদের ক্যাম্পে। কী অসম সাহসী কাজ? ভেবে দেখুন। ক্যাম্পে নিয়ে এই ছেলেটিকে আরও মেরেছে। আরও মেরেছে। আরও মেরেছে। বাচ্চা একটা ছেলে, টিনএজার, ভাবুন একবার? আপনাদেরও তো ঐ বয়সের ভাই, ভাগ্নে বা পুত্র কন্যা আছে।
ঘটনা তো আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন। রমেল মারা গেছে। ওর বিরুদ্ধে কার কী অভিযোগ ছিল জানি না। বীরপুরুষ মেজর সাহেব কী অপরাধে ওকে গ্রেফতার করেছিল জানি না। আর জানার উপায়ও নাই। ঐ লিকলিকে কানা ছেলেটা আর বেঁচে নাই। ওকে পিটিয়ে মেরেই ফেলেছে আমাদের সেনাবাহিনী।
(৩)
এইটুকু ঘটনা জানানোর জন্যে এই পোস্ট না। এই পোস্টটি হচ্ছে একজন পিতা হয়ে আপনাদের সকলের কাছে একটা ফরিয়াদ জানানোর জন্যে। ফরিয়াদটা জানাচ্ছি, তার আগে জেনে নিন রমেলের লাশের কী অবস্থা।
ওর লাশ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে প্রথমে নিয়ে আসা হয়েছিল ওর গ্রামে। প্রথমে গাড়িতে, গাড়ি থেকে নামিয়ে ট্রলারে। কেননা ওর গ্রাম অবধি গাড়িতে লাশ নেয়ার মতো রাস্তা নাই। লাশ রমেলের বাড়ির আঙ্গিনা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনি, তার আগেই আর্মির লোকেরা ওর লাশ জড়ো করে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় এক বাঙালী মেম্বারের বাড়িতে রেখেছিল। এটা ছিল গতকালের ঘটনা। আজ সকালে আর্মিরা রমেলের লাশ আর সাথে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে নিয়ে একটা ট্রলারে করে রওনা দেয় অজানা গন্তব্যে।
সর্বশেষ খবর যেটা জেনেছি- রমেলের লাশ পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আপনাদের কাছে ফরিয়াদ করি। রমেলের বয়সী আমার সন্তান আছে। আমি কল্পনা করি রমেলের জায়গায় যদি আমার সন্তানটি থাকতো তাইলে এখন এই মুহূর্তে আমার কী অবস্থা হতো! আমি ভাবতে পারি না। দূর পাহাড়ের আদামে বাস করা ওর পিতা, আমার বয়সীই হবে, হতো দুই এক বছর বড় বা ছোট, সেই লোকটির মনের অবস্থা একবার ভাবতে পারেন? ঐ পিতা এখন কী ভাবছে, কী করছে? আর ওর মা? আদিবাসী একটি গ্রাম্য মহিলা- ওর অবস্থা? কারো কাছে কোন অভিযোগ করার মতো মনের অবস্থায়ও তো ওদের থাকার কথা না।
ঐ হতভাগা বাবা-মায়ের হয়ে আমি আপনাদের কাছে ফরিয়াদ করি। আমার ছেলেটিকে ওরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আমার তরতাজা কিশোর ছেলেটি, আশা ছিল লেখাপড়া শিখে একদিন মানুষ হবে- ওকে ওরা পিটিয়ে মেরেছে। যে ছেলের গায়ে একটা কাঁটার আঁচড় লাগলে আমার বুকে রক্তক্ষরণ হতো, সেই ছেলেটিকে ওরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওকে পিটিয়েছে, ওর হাত পা ভেঙ্গেছে, ওর সারা গা ক্ষতবিক্ষত করেছে। আমার ছেলেটি কি কাঁদছিল? কান্নার শক্তি কি ছেলেটির শেষ পর্যন্ত ছিল?
(৪)
আমার ছেলেটিকে ওরা মেরে ফেলেছে। মেরেই থেমে থাকেনি। ওর লাশটাকেও দেখতে দিল না। ওর হতভাগী মা, যে মা ওকে প্রায় দশমাস গর্ভে ধারণ করেছিল, বুকের দুধ খাইয়ে ওকে বড় করেছে, সেই মা তার নাড়িকাটা ধন ছেলের মৃত মুখটা দেখতে পেল না। পুত্রের মৃতদেহটি বুকে জড়িয়ে বেচারি দুখিনী মা একবার কাঁদবার সুযোগ পেল না। হতভাগা পিতা- আপনারা বলেন পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু- পিতা তো সেই ভারটি বহন করার সুযোগটি পেল না। মৃত পুত্রের মুখে শেষবার একবার হাত বুলিয়ে আদর করতাম- সেই সুযোগটিও ওরা দিল না।
আপনারা কি বিচার করবেন না? আমার এই ছেলেটি কি গোলাম আজমের চেয়ে বড় অপরাধী ছিল? কসাই কাদেরের চেয়ে? কামারুজ্জামানের চেয়ে? ওদেরকেও তো আপনারা বিনা বিচারে মারেননি। আমার ছেলে যদি কোনো অপরাধ করে থাকে, ওর বিচার করলেন না কেন? গোলাম আজমের জানাজা দিলেন পুলিশ পাহারায়, আর আমার ছেলের লাশটি কেন পুড়িয়ে দিলেন? কী অপরাধ করেছিল সে? শুধু আদিবাসী বলে? আদিবাসীরা কি মানুষ না? ওরা এই দেশের নাগরিক না?
আপনারা কি এর বিচার করবেন? করবেন বিচার? নাকি আপনারাও ঐ খুনিদের দলে? নাকি আপনিও সেই খুনিদেরই একজন?