যৌথ ও যৌন জীবনে আত্মিক বন্ধনটা জরুরি

শিল্পী জলি:

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি তখন সহপাঠীর মুখে শুনেছিলাম রাতের বেলা নাকি পাশের হলের ছেলেরা কাঁথা মুড়ি দিয়ে আসতো দেয়ালের উপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে, হলের মেয়েরা হলে আদৌও কিছু পরে থাকে কিনা!

শুনে অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু তাদের এই আচরণের কারণ বুঝিনি। ভেবেছিলাম, বেকুব নাকি, দিনভর বাইরে যাদের দেখছে শীতের রাতে তাদেরই আবার দেখতে আসবে কাঁথা মুড়ি দিয়ে!
আরেকবার আরেক ছেলের মন্তব্য শুনেছি, কোন এক হলের ছাদে মেয়েরা নাকি স্লাটের মত হাঁটাহাঁটি করে ছেলে ধরতে–এত খারাপ মেয়েদের চরিত্র !
যেখানে পতিতারাই ভালোবাসায় না জড়ালে বিনে পয়সায় সঙ্গম সাধে না সেখানে সাধারণ মেয়েরা মনে না ধরলেও কি যাকে তাকে ধরতে গিয়ে দাঁড়ায়–সম্ভব?

যাই হোক, যৌনতা প্রাণীকুলের মৌলিক চাহিদার একটি হলেও বলতে গেলে এটা আমাদের সমাজে মেয়েদের জন্যে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ– সেটা বিবাহিত বা অবিবাহিত সব নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যদি না বাচ্চা জন্মদানের বিষয়টি এর সাথে সম্পর্কিত থাকতো তাহলে আমাদের সমাজে মেয়েদের জন্যে সেক্সের ‘এস’ ও বৈধ হতো কিনা, সন্দেহ।

এক অল্পবয়সী মেয়ের বিয়ের চার বছরে দু’টো বাচ্চা হতেই স্বামী সহবাসে অপারগ হয়ে যায়। সেই কথা সে তার স্বামীর সাথে বলতে পারেনি, বলেছিল ননদিনীকে। অতঃপর ঈ-প্রত্যয় যোগে মা +গ, এবং ছাগী শব্দসহ নানা শব্দে জর্জরিত হয়েছে সে, কিন্তু আসল কোন উপায় নির্ধারণ হয়নি। অথচ বিয়ের কথা ছিল স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে পথ চলবে একসাথে, সমস্যাও দু’জনে মিলে সমাধানের চেষ্টা করবে। কিন্তু আমাদের সমাজ সে ক্ষেত্র কোনদিনই তৈরি করতে পারেনি, শুধু পেরেছে ছেলেদেরকে প্রভু এবং মেয়েদেরকে ভৃত্যের মর্যাদায় রেখে দিতে।

অহরহ সাধারণ জনগণ ধর্মীয় দোহাই দিয়ে বলে, স্বামীর ইচ্ছেই স্ত্রী’র ইচ্ছে। স্বামী যা বলবে তাতেই স্ত্রী’র মাথা কাত করা জায়েজ এবং ১০০ ভাগ সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অন্যথা হলে, দোজখের আগুন অবধারিত। তদুপরি, ধর্মমতে মেয়েরা একটু তেড়িবেড়ি করলেই মাথার উপর বাইনসহ তিন তালাকের খড়গ ঝুলন্ত।

সমাজও অনেকটা তেমনই মনে করে। ভাব বুঝে আমাদের সমাজে মেয়েরাও তেমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বড় হয়, তারপরও হয়ত শেষ রক্ষা হয় না। জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে হয়ত ঝামেলা বেঁধেই যায়। কেননা নারীপুরুষের সম্পর্ক যত সহজ মনে করা হয় আদতে তত সহজ নয়। তথাকথিত প্রভুও পথিমধ্যে ক্লান্ত হতে পারে, যখন ভৃত্যসম সহচরীর হাতটি ধরা জরুরি হয়ে পড়ে, অথচ যার ভিত্তি তৈরি করতে হয় সময় থাকতে, আত্মিক বন্ধনের মাধ্যমে।

ধর্মে এবং সমাজে সরাসরি বা অ্যাঙ্গেলে পুরুষকে অহরহ নারীর উর্ধ্বে দেখতে শেখানো হয়। অতঃপর নিজেকে অবিরত জয়ী বা ঊর্ধ্বে দেখতে দেখতে অনেক পুরুষের মধ্যেই তৈরি হয় ইগো সমস্যা, অথচ একদিন বিয়ে করতে হয় একজন অধম নারীকেই, যাকে হয়তো আর সহযাত্রী এবং বন্ধু হবার যোগ্য বলে ভাবা সম্ভব হয় না। বরং মনে হয় একজন বৈধ সেবাদাসী এবং জৈবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যম– সন্তান উৎপাদনের মেশিন বৈ আর কিছু নয়।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে সমকক্ষ না ভেবে অহরহ নিচু ভাবলে বন্ধন যাই হোক না কেন ওখানে কোন আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয় না l সেখানে আইন-কানুন-ধর্ম বা বিয়ের লক্ষ মন্তর অকার্যকর হয়ে পড়ে। কেননা মানুষের মনের উপর কোন জোর খাটে না। আবার সমাজ বা ধর্মের দোহাই দিয়ে মনকে ধরে জেলেও পোড়া সম্ভব নয়। তাছাড়া দোজখ তো মরনের পর। অপমানে যার ইহকালই দোজখ হয়ে যায়, সে আর কতক্ষণ পরকালের দোজখ নিয়ে ভাবে ?

তারপরও এক মেয়ের গল্প শুনেছিলাম–ধর্ম ভয়ে ভীত মেয়ে কবুল পড়ে বিয়ে করেছে বটে, কিন্তু কিছুতেই বরকে ভালোবাসতে পারছে না। অতঃপর সে তার মাকে বলে তাবিজ নিয়েছিল যেনো অকস্মাৎ বরের প্রতি তার ভালোবাসা এসে যায়।
থাক সে কথা।

ছোটবেলায় আমরা রূপকথার গল্প শুনতাম, যেখানে রাজকন্যাকে বিয়ে করতে নানা দেশ থেকে রাজকুমাররা আসতো, আর বিয়ে হতো তার সাথে যে যুদ্ধে বা দৈহিক পারদর্শিতায় বিজয়ী হতো।
এসব গল্পে কখনও বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেদের মানবতা, উদারতা, বন্ধুত্ব, কেয়ার, বা ত্যাগকে তেমন ফোকাস করা হতো না।
গল্পগুলো ছেলেরাও শুনতো আর শিখতো একটি বিষয়ই–তাদেরকে দৈহিকভাবে পারদর্শী এবং সেরা হতে হয়, এবং ছেলেদের জীবনে ব্যর্থতার কোন স্হান নেই।

তদুপরি সমাজেও বাবা-মা দিনরাত শেখায়, ছেলেদের কাঁদতে নেই (কেন?)!
অতঃপর একটু বড় হতে না হতেই ছেলেদের মনের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়ে যায়–কে সেরা ?
আমি না পাশের বাড়ির নূরু মিঞা?
আর নির্ণায়কের ভিত্তি– তাদের দেহ, লিঙ্গ, যৌনশক্তি, শিক্ষা, অর্থ, প্রভাব, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি….নইলে হায় !

এই তথাকথিত মর্দ হবার চাপে কৈশোরে পা দিতে না দিতেই অনেক ছেলেদের জীবনে হায় হায় শুরু হয়ে যায়। তারা অন্যের তুলনায় নিজের দেহ মাপে, লিঙ্গ মাপে, আর ভাবে জগতে আমি ছাড়া অন্য সবাই-ই ভালো পজিশনে। অথচ মনের গোপন দুঃখটি কাউকে বলতে পারে না–হীনমন্যতায় ভোগে।
কেউ কাঁচা ছোলা চিবোয়, কেউ কাঁচা ডিম খাওয়া বাড়ায়, কেউবা মোরগের টেস্টিকল হলুদ-লবন-পানি দিয়ে গিলে….
তবুও কি কাজ হয়?
ঘায়েল মনের সন্তুষ্টি কি মিলে?

জগতে সেরা পালোয়ান থেকে শুরু করে কোন পুরুষই চিরসুখী নয়–কারও আকৃতির সমস্যা, তো কারও প্রকৃতির। কারও টিউনিংয়ের ঘাটতি, তো কারও সময় বা ক্লিক সমস্যা। কেউ আবার জানে না নারী মনের সিস্টেম। আর নারীর মনই যদি জয় করা না যায়, কোন পুরুষের বাপের সাধ্য নেই তার দেহকে জয় করে। ফলাফল–সবাই একই গোয়ালের বাসিন্দা। অথচ সমাজ সে শিক্ষাটিই পুরুষকে দেয় না।

কখনও কখনও দেহ বা মননে সক্ষম পুরুষও সময়ের কাছে বাঁধা পড়তে পারে। যখন সহযাত্রী নারীটিই সর্বাধিক সহযোগিতা দিতে সক্ষম, যদি ততদিনে আত্মিক বন্ধনটি মজবুত করে নেয়া হয়ে থাকে– যার একমাত্র উপায় সত্যিকারের ভালোবাসা, সম্মান, এবং স্বীকৃতি। সম্ভবত সেই কারণেই নারী শরীরকে সেইভাবে তৈরি করা হয়েছে যেনো প্রতিবার সঙ্গমের আগে তার মনকে জয় করা হয়। আর ঐ আত্মিক বন্ধনের উপরই পুরুষ এবং নারী নির্ভর করে একে অন্যের সহায়তায় আজীবন পথ চলতে পারে।

সমাজে নারীকে অবলা, অধম বা ….যাই দেখাতে চাওয়া হোক না কেন, নারী অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে বেশী সুবিধাজনক পরিস্হিতিতে রয়েছে। তারা যেমন গর্ভধারণ করতে পারে, আবার ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায় সঙ্গমেও লিপ্ত হতে পারে। আবার প্রকৃতিগতভাবেও নারী মমতাময়ী এবং সহনশীল। কিন্তু পুরুষকে সেভাবে তৈরি করা হয়নি। প্রতিবার সঙ্গমে তাকে ইরেকশন, সময়, ইজাকুলেশন নিশ্চিত করতে হয়।

নারীর একবার/ দু’বার/ তিনবারের ডেলিভারি নরমাল না হলে ফরসেপ, সি-সেকশন ইত্যাদির ব্যবস্হা আছে। কিন্তু পুরুষের প্রোপার ডেলিভারি না ঘটলে তারা না পারে কইতে, না পারে সইতে। শুধু ভোগে ইগো প্রবলেমে–ভেতরে ভেতরে একেবারে নেই হয়ে যায়। অথচ এসব টুকিটাকি সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাধানযোগ্য, যদি সময়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়।

মানুষই তো–সমস্যা থাকবেই। সময়ের সাথে শরীরে রোগ বালাই এসে বাসা বাঁধবে। হয়তো যৌনজীবনও অনেকটা বিঘ্নিত হবে। তাতে কী? চিকিৎসাও আছে। জীবনকে সহজভাবে নিতে শিখলে অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব– হয় ঘরে, নয় ডাক্তারের সহায়তায়।

নিয়মিত ত্রিশ মিনিট ব্যায়াম, কিগাল এক্সসারসাইজ (মধ্যপথে দশ সেকেন্ড প্রস্রাব বিরতি/ রেকটাম সংকোচন করে দশ সেকেন্ড হোল্ড করা ব্যায়াম, দিনে কয়েকবার),পর্যাপ্ত ফল-ফলালি-সব্জি ভক্ষণ, পর্যাপ্ত ভাইটামিন, মিনারেল,…. বিশুদ্ধ পানি পান, হুক্কা- স্মোকিং-মদ-গাঁজা-ভাং ত্যাগ, এবং ব্লাডপ্রেশার, ডায়বেটিস, ডিপ্রেশন, টেনশন ইত্যাদি নিয়মিত নজরে রাখলে হয়তো সমস্যাই কাছে ভিড়বে না, বা ভিড়লেও পালাতে কতক্ষণ?
আর ডাক্তারতো রয়েছেই।

যদি যোগ্য সাথী পাশে থাকে, তাহলে জীবনে কোন সমস্যাই সমস্যা নয়। মেয়েদের যে মন একবার রাঙে, সে মন চাইলেও সহসা হাত ছাড়তে পারে না, যদি না অহরহ কাঁটার আঘাতে আগেই ঘায়েল হয়ে থাকে সে!

শুনলাম জীবন বাঁচাতে এক মেয়ের অপারেশন জরুরি। এতে হয়তো তাদের যৌনজীবন সাময়িকভাবে কিছুটা বিঘ্নিত হতে পারে। বিশ-বাইশ বছরের বিবাহিত জীবন। আত্মীয়-স্বজন বলছে অপারেশন না করতে, যদি বিয়ে ছুটে যায়! বিশ-বাইশ বছরেও কারও বিয়ে যদি এটুকু জোড়া না লাগে, ঐ বিয়ে থাকলেই কী, আর না থাকলেই বা কী?

আমাদেরই এক সহপাঠী ভালোবেসে এক মেয়েকে বিয়ে করে প্রথম ভারতে নিয়ে গিয়েছিল অপারেশন করিয়ে আনতে, অতঃপর শুরু হয় তাদের যৌথ জীবনের পথ চলা, আবেগে বিভোর হওয়া।

আমেরিকায় এক মেয়ে বলেছিল, বাচ্চা জন্মদানের পর তার গা দিয়ে পঁচা গন্ধ বের হচ্ছিল…. সে হয়তো মরেই যেতো যদি না সময়ে বর তার আবিস্কার করতো যে ডাক্তার ভুল করে গজ রেখে দিয়েছে তার শরীরের ভেতর। স্বামীর ভালোবাসায় সে যাত্রায় সে বেঁচে যায়। এখনও সে কৃতজ্ঞ, ভালোবাসায় বিভোর।

বৈবাহিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সহায়ক। যেখানে জৈবিক সম্পর্ক পাঁচ পারসেন্ট হলে আত্মিক বন্ধন পঁচানব্বই পারসেন্ট। ঐ পাঁচ পারসেন্টে কারচুপি চললেও পঁচানব্বই পারসেন্টে কারচুপি চলে না। চললে, ঘুড্ডি ভোম ঘটে যখন তখন।

ভালোবাসা শুধুই কিছু শব্দ নয়– অ্যাকশন!
যেসব পুরুষ বলে, মেয়েদেরকে মুগুড়ের উপর রাখতে হয়….যখন তখন হম্বিতম্বি করে, অকারণ রাগ ঝাড়ে, অহরহ নিচু দেখায়, তারা কখনই মেয়েদের সত্যিকারের ভালোবাসা পায় না !

কথায় আছে, পঁচাত্তর বছরের পুরোনো অপমানও নাকি মেয়েরা কোনদিন ভোলে না– সেক্ষেত্রে আত্মিক সম্পর্ক ঘটে কী করে?
আত্মিক বন্ধনই বিয়ের ভিত, নইলে ভালোবাসার বিয়েও ফটাস হতে সময় লাগে না!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.