‘আমার সাথেই কেন এমনটা হয়’

সালমা লুনা:

তোমার সাথেই এমনটা কেন হলো?
কই, আমার সাথে তো হয় না!

সেই কবে থেকে এসবের শুরুটা হয়েছিল তা তো আর সন তারিখ ধরে মনে নেই ! তবে যে জন্য এমন ভাবনা থানা গেঁড়ে বসেছে মগজে, সেই ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করেছিলো এবং বুঝতে শুরু করেছিলাম সেই ক্লাস সিক্স সেভেন থেকেই।
তখন তো খুব বাসে ট্রেনে যাতায়াত হতো। নানাবাড়ি দাদাবাড়ি যাই স্কুল ছুটি হলেই। বাবার চাকরিস্থল থেকে ট্রেনে বাসে করে আসতে হতো।

সেখানেই প্রথম টের পাওয়া। ভীড়ের মধ্যেই কেউ চিমটি দেয়, বাহুর পাশ দিয়ে কনুই দিয়ে ঠ্যালা, পিঠে হাত বুলিয়ে অন্তর্বাসের ফিতে খোঁজ করে, পশ্চাদেশে চকিত হাতের স্পর্শ! কী ঘেন্না লাগে! ভয়, মন খারাপ কাউকে বলতে না পারা। আর এই অনুভব – খালি আমারই কি হচ্ছে? আর কারো সাথে হয় না কেন! কেউ তো বলছে না!

একবার তো ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে স্কুল গেইট থেকে রিক্সায় না উঠেই তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আবার স্কুলে ঢুকে পড়েছিলাম, তারপর বাসায় ফোন করে কান্নাকাটি করলে আম্মা হেড মিস্ট্রেসের সাথে কথা বলে আয়াকে দিয়ে স্কুল থেকে আনিয়েছিলো তের বছর বয়সী ভীত আমাকে। শরীরের প্রাইভেট পার্টসে গুঁতো দেয়া, পান খেয়ে লাল দাঁত বের করে হাসতে হাসতে চলে যাওয়া বয়স্ক একজন মানুষ এরপরে কিছুদিন স্বপ্নেও তীব্র ভীতি প্রদর্শন করতে এসেছে বহুবার।

এরপর শুরু হলো বাস-ট্রেন থেকে নামার সময় অতিরিক্ত সতর্কতা, কেউ ছুঁয়ে দিতে যেন না পারে। কিছুটা প্রতিরোধ প্রতিরক্ষাও করতে শিখলাম মরিয়া হয়ে। একবার একজনার আঙ্গুল মুচড়ে দেবার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছিলাম। ততদিনে আমি শিখে গেছি অনেক ভীড়েও নিজের শরীরটাকে ঘিনঘিনে স্পর্শ থেকে বাঁচাবার কৌশল। ক্ষেত্রবিশেষে চেঁচিয়ে প্রতিবাদের ভাষা।
তবুও বিয়ের দুবছর পর ভাগ্যক্রমে বেইলি রোডের সরকারি আবাসনে এক প্রবাসী সরকারী কর্মকর্তা আত্মীয়ের রেখে যাওয়া বাসায় যখন কিছুদিন সংসার করার সুযোগ মেলে তখন বুঝতে পারি আমি এখনো সেই ভীতু কিশোরীটিই আছি ।

মাস্টার্স শেষ হয়নি তবুও বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি আর ফিজিক্সের মতো খটোমটো সাবজেক্টের মাস্টার্সের পড়া দুটাই একতালে চলছে। স্বামী অফিসে, রান্না খাওয়া যৎসামান্য। নিজের বলতে বইপত্র, কিছু থালাবাসন আর কাপড়চোপড় – তাই কোন কাজই নেই । পড়তে পড়তে বিকেলে হাঁপ ধরলে খুপরি বারান্দায় বসি। রাস্তার পাশে ছতলা বিল্ডিং। অনেকগুলো বিল্ডিংএর আবাসিক এলাকা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা, বাইরের ফুটপাথে আবার বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড, যা রাস্তা থেকে বেড়া এবং বিল্ডিং এর খানিকটা আড়াল করেছে।

হঠাৎই এক বিকেলে দেখি সাইকেল থেকে এক লোক নেমে বিলবোর্ডের আড়ালে বেড়ার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে, তার দৃষ্টি উপরের দিকেই। চোখ সরিয়ে নিলাম স্বাভাবিক ভাবেই, সে নিশ্চয়ই মুত্রত্যাগ করছে – এই ভেবে। কদিন হয়তো খেয়াল করিনি। এরপর আবার একদিন দেখলাম, এরপর আবার! এরপর প্রতিদিন!
সন্দেহ হলো। ভালোকরে তাকিয়ে থেকে যা দেখলাম তাতে ভয়ে আতঙ্কে রাগে ক্ষোভে গা কাঁপতে লাগলো। আমি ছতলায় থেকেও মেইন গেট লক করে ঘরের ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এরপর ওই সময়টাতে আর অনেকদিন বারান্দায় বসিনি।
অনেক পরে একদিন সন্ধ্যার দিকে নীচে প্রচণ্ড হৈচৈ শুনে এগিয়ে গিয়ে কারণটা জেনেছিলাম, ওই লোকটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওই বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে তার একান্ত ব্যক্তিগত অঙ্গটি বের করে খুলে দেখায়, এটি এই বিল্ডিং এর সবাই দেখেছে।  এবং আজকে এক বুয়া বটি নিয়ে বেরিয়েছে তার দফারফা করবে বলে, এবং সে নাকি ওই বুয়ার এক্স হাজব্যান্ড! আমি কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। যা পেরেছিলাম তা হলো ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছিলাম।

কেন এই ভয়?

আমার মনে হচ্ছিল, কেউ বলবে – তুমি/আপনি দেখ বা দেখেন কেন এসব? তোমার/আপনার সাথেই কেন হলো এমন? আমাদের সাথে তো কেউ করেনা!

এইসব এখনো চলছে ! এবং আমি এখনো এই ট্রমাতেই আছি।

আমি লেখায় প্রায়শঃই হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা লিখ । লিখি নিজের তাগিদ থেকে । কিন্তু কিছু কথা আসলেই যা বলা দরকার তা বলতে পারি না। বলা যায় না বলেই।
আমি এরকম ঘটনার মুখোমুখি কত যে হয়েছ ! ছোটবেলা থেকেই।
কেউ বলতো মূখে না তবু আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল কেন জানি! ভাবতাম – আমার সাথেই কেন এমন হয় !

আমি ফেসবুকে স্বামী সন্তান সহ ছবিটবি দেই। ছেলেমেয়েরাও মাশাল্লাহ বেশ বড়ই। আমাকে দেখে তো বোঝা যায় একজন মধ্যবয়সী নারী , তবুও আমার ইনবক্স দেখলে বমি করে দিতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। সেদিন এক আইডি রিকো পাঠিয়ে আবার ইনবক্সে লিখেছে সে সেক্সচুয়ালি অতৃপ্ত নারীদের সেবায় নিয়োজিত এবং অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে সে এই সেবাটি অর্থের বিনিময়ে বা অর্থ ছাড়াও চাইলে বাসায় হোটেলে এবং মনপসন্দ মতো জায়গায় দিতে সে রাজী।
আরও থাকে ওই বেইলি রোডের লোকটির মতো কিছু লোকের পাঠানো প্রাইভেট পার্টের ছবি। কিছু নোংরা কথা। কিছু নোংরা প্রস্তাব।

আমি সব ডিলিট করি দ্রুততার সাথে। রাগে হাতপা কাঁপে। আমি ভাবতে থাকি আমার সাথেই কি হয়? ওই যে ইউনিভার্সিটির শিক্ষিকা আপাটি, কাঁচাপাকা চুলের চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যবসায়ী নারী, স্কুল শিক্ষিকা বা চাকুরিজীবি খুব স্মার্ট মেয়েটা, কি প্রতিদিন পিপি পাল্টানো ওই সুন্দরী আমার বয়সী নারীটি – সেও কি পায়? এরকম আমারই মত ! নাকি শুধু আমিই ?

আমি কী করতে পারতাম এক্ষেত্রে?
বিশেষ সেলে অভিযোগ? ফেসবুকে আইডিটি ফাঁস করে দেয়া! রিপোর্ট করতে বলা?
একটা পোস্ট দিয়ে সবাইকে এই কাণ্ড জানানো?

আমার আইডিতে স্বামী আছেন, 18+ পুত্র আছে, বোনেরা আছে, আছে চাচা ফুপু খালা এবং শ্বশুরকূলের তাবৎ আত্মীয়। আছে ছেলেমেয়ের বন্ধুবান্ধবদের মায়েরা, নিজের ছেলেবেলার বন্ধুরা, কিছু সহকর্মী কিছু পরিচিতজন। কিছু প্রতিবেশী এবং ফেসবুকেই পরিচয় হওয়া চমৎকার কিছু বন্ধু। আমার দুঃখ, আমি একজনের মুখটিও মনে করতে পারলাম না তাদের কেউ আমার সাথে ঘটা এমন অসংখ্য অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে।

তারা বরং এটিকে অন্যায় ভাবলেও আমার এ নিয়ে কথা বলাটাকে ‘অনর্থক’, ‘বৃথা হৈচৈ’, এদের টেক্সট দেখার কী দরকার , ব্লক করে দিলেই হয়, লোকজন জানানোর কী দরকার, কই আমাকে তো কেউ পাঠায় না( !) , তুমি এত সুন্দর সুন্দর ছবি দাও কেন, তুমি জানো না ফেসবুকে কত বাজে লোক থাকে, আইডি রেস্ট্রিকটেড করে দাও, পাবলিক পোস্ট দিও না , এত লেখালেখির দরকার কী, তুমি কি লেখিকা, লিখলে কী হয় – ব্লা ব্লা ব্লা।

অনেকে সামনে না বললেও আড়ালে বলবে। চলবে মুখ টিপে হাসাহাসি।
বলা হবে, নারীবাদী হওয়ার চেষ্টা ।

বেদনা, বড় বেদনা !

তবে চেষ্টা একটা তো আমার থাকেই !
সেটি নারীবাদী নয় বরং মানবতাবাদী হবার চেষ্টা ।
চেষ্টা থাকে আমার কন্যা, বোনের কন্যা আত্মীয়দের কন্যাদের ভবিষ্যতটি সুরক্ষিত করার। চেষ্টা করি অমানুষদের মনুষ্যত্ব জাগানোর। চেষ্টা করি নিজের ভাবনাকে অন্যের সাথে ভাগ করতে এবং অন্যের ভাবনাটিও বুঝতে ।

ফেসবুকে একবার এধরনের অভিযোগের একটি পোস্ট দেয়ায় ময়মনসিংহের একজন সাবেক ছাত্র ইউনিয়নের নেতা যিনি একজন সাংবাদিকও বর্তমানে। তিনি আমাকে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন আপনার সাথে কেন হচ্ছে আমাদের সাথে তো এসব হয়না ! আমাদেরকে সবাই কত সম্মান করে !
যেন আমি নিজেই অসম্মানিত হওয়ার জন্য দায়ী। যেন আমিই একমাত্র ।

সত্যিই তো, আমার সাথে ই কেন হচ্ছে! আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না সেই কিশোরীবেলা থেকেই আমার মাথায় কেন ঢুকে গেলো, আর কারো সাথে হয়না কেবল আমার সাথেই হচ্ছে।
যেখানে আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি প্রতিদিন অসংখ্য নারীর সাথে কিশোরীর সাথে এমনকি একটা শিশুর সাথেও এমনটা ঘটে। বেশীরভাগই প্রতিবাদ করে না। কাউকে জানায় না।

কেন করে না?

ভাবি , শুধুমাত্র এই প্রশ্নটির জন্য।
যে প্রশ্নটিকে এখনো আমার এত ভয়!

আচ্ছা , এই প্রশ্নটিকে আমরা এতো ভয় কেন পাই?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.