আত্মহত্যা কখনও স্বেচ্ছামৃত্যু না

জিনিয়া চৌধুরী:
আত্মহত্যা বিষয়টা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাড়াতে পারছি না। কানের ভেতর গুনগুন করে কিছু একটা বার বার বকে যাচ্ছে, আত্মহত্যা মানে স্বেচ্ছামৃত্যু নয়। এর ভয়াবহতার শেকড় আরো গভীরে প্রোথিত। প্রতিটি মানুষই আসলে নিজেকে ভালোবাসে।সখ করে কেউ মরে যায় ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য না।তাকে আসলে মরে যেতে বাধ্য করা হয়।
আজকের প্রথম আলো এবং আরো একটি জীবনের ঝরে যাওয়া। বাল্যবিবাহ ঠেকাতে না পেরে মৃত্যুকে বেছে নেয়া মেয়েটি কতোটা বাধ্য হয়েছিলো যে, তার কাছে তখন জীবনের চাইতে মৃত্যুটা বেশী সহনীয়, বরণীয় হয়ে উঠেছিলো। এ গল্পটা কী আসলে স্বেচ্ছামৃত্যু? না হত্যা?
ধরা যাক, তিন মিনিট থেকে ৩০ মিনিট কোনো জুটির ভালোবাসা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া সহবাস দৃশ্য ভাইরাল হলো। কে করলো? তার সাথের পুরুষটি। সমাজ যদি সেই পুরুষটিকে অপাংক্তেয় ঘোষণা করে? বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে যদি সিদ্ধান্ত নেয় ঐ কাপুরুষ বিশ্বাসঘাতকটিকে সমাজচ্যূত করার? তাহলেই কিন্তু পাল্টে যেতো দৃশ্যপট।
সমাজ যদি নারী শরীরকে সাধারণ মানুষের শরীর ভেবে নিতো, একজন নারী যদি নিজের শরীরকে ঢাকাঢাকির ঢাকঢোলে সমর্পিত না করতো, জানি তাহলেও পাল্টে যেতো দৃশ্যপট। কিন্তু তা হয় না, কিছু পাল্টায় না। কেবল মেয়েটি তার সবচে সুন্দর সময়টাকে পরিস্থিতির কষাঘাতে রক্তাক্ত করে, সমাজ তাকেই বয়কট করে, পরিবার তাকে বারবার ধিকৃত করে। তাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়, তার ভালোবাসাবাসি ভুল ছিলো, তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো, তার শরীর আর সুখ আহরণ ভুল ছিলো, তাকে তার নিজের শরীরকে ঘৃণা করতে শেখায়। সে তখন নিজের সবচে বিশ্বাসী পুরুষটির অবিশ্বস্ততায় সেই পুরুষের শাস্তি দাবি না করে নিজের ওপর সমস্ত দায় চাপিয়ে দেয়, আবার নিজের শরীরটাকেই কষ্টের ঘেরাটোপে ঢুকিয়ে পেতে চায় কাঙ্খিত মুক্তি। আর পুরুষটি বুক ফুলিয়ে উদযাপন করে তার পুরুষদণ্ডের নোংরা স্বাধীনতার উল্লাস।
সময়টা পাল্টাচ্ছে, মেয়েদের এবার নিজেদের দিকে তাকানোর সময় হয়েছে, নিজের শরীরকে বোঝা ভাবার দিন শেষ। তার নিজেকে ঘেন্না করার প্রবণতা থেকে তাকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের ভালো লাগাকে দিতে হবে সম্মান। ভাবতে হবে তার ভালোবাসা আর বিশ্বাসে ঘেরা ঐ ৩ অথবা ৩০ মিনিট যাই হোক না কেন, সেটা কোন নোংরামি নয়। সেটা তার জীবনের হয়তো কোন এক শ্রেষ্ঠ সময়। বিশ্বাসঘাতকটিকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হলে তাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। যুদ্ধটা বেঁচে থেকে করতে হবে। জানতে হবে, জানাতে হবে লজ্জাটা তার নয়। লজ্জা ঐ বিশ্বাসঘাতকটির, যে পুরুষ ছিলো ভালোবাসার অযোগ্য।
আর আমাদের সকল স্তরের নারীরদের দাঁড়াতে হবে ঐ দুঃখী, প্রতারণার শিকার হওয়া নারীটির পাশে, যেন সে হতে পারে একজন মুক্তিকামী যোদ্ধা, নারী মুক্তির জন্য করা সেই যুদ্ধটা যাতে সে করতে পারে, দিতে হবে তাকে সেই মানসিক সাপোর্ট।
ধর্ষণ নারীর না, পুরুষের কাম বিকৃতি। এর দায় সম্পূর্ণ ধর্ষকদের। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘুরিয়ে দেখা দৃষ্টিভঙ্গির সমুচিত জবাবটা দিতে হবে বেঁচে থেকে। মরে গিয়ে, মুখ লুকিয়ে সমাজ,রাষ্ট্র আর ধর্ষককে বাঁচিয়ে দেয়ার প্রাগতৈহাসিক মানসিকতা পরিহার করতেে হবে নারীদের। কিছু বছর আগে এ দেশের একজন নারী সেলিব্রেটির কিছু অন্তঃরঙ্গ ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সেই নারীটির ঘুরে দাঁড়ানোর সাহসকে আমি স্যালুট জানিয়েছিলাম। আমার এক পুরুষ বন্ধুর হাসিমুখে বলা–যে, আমার এখন ঐ নায়িকার নাটক দেখতে গেলে আমি আর তার অভিনয় দেখি না, দেখি তার ভেতরের চেনা শরীরটাকে।
আমি অবাক হইনি শুনে,পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাধারণ পুরুষগুলো এমনটাই বলবে, আমি জানি। শুধু বলেছিলাম, শোন, তুই কার মুখ কল্পনা করে মাষ্টারবেট করলি সেটার জন্য যেমন ঐ নারী মুখটি দায়ী না, তেমনি তুই তার শরীর দেখে কী ভাবলি তাতেও তার কিছু এসে যায় না।
নারীকে বুঝতে হবে, তার পশ্চাৎদেশ দেখে কোন পুরুষটির দণ্ড কোথায় কতোটা উত্তেজিত হলো সেটা তার সমস্যা, নারীর শরীর বা পোষাকের সমস্যা নয়।
ঘুরে দাঁড়িয়ে পুরুষের গালে, সমাজের গালে চড় দেয়ার সাহসটা খুব দরকার, মৃত্যুর দায়টাও নিজের ওপর নেয়ার মানসিকতা পরিবর্তন করে, বরং পরিবর্তন জরুরি এই সমাজের। নারীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করার। পরিবারগুলো এখনই শিক্ষা দিক তার ছেলেটাকে, কারণ প্রযুক্তি এতোটা এগিয়ে গেছে যে, এখন চাইলেও ছেলে শিশুটিকে আলাদা করে রাখা যাবে না তা থেকে। বরং তার যৌনযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার, মেয়েদের সম্মান করার, এবং সর্বোপরি তাকে পুরুষ না বানিয়ে মানুষ হবার শিক্ষাটা শুরু করুক এখুনি।
আর একটি মৃত্যুকেও আমি স্বেচ্ছামৃত্যু বলতে রাজী নই। খুনি ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শাস্তি প্রাপ্য। হয় শাস্তির দায় নাও, অথবা বদলাও। এটাই হোক নারীমুক্তির প্রথম স্লোগান।
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.