সালমা লুনা:
প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কেন যে মনে হলো দ্রৌপদীর, আর একটা যুদ্ধ দরকার। একজনের জন্যে হলে, হাজারটা দ্রৌপদীর জন্যও কি আর একবার একটা মহাভারত হতে পারে না?
সে ভাবতেই থাকে দ্রুত ,একটা ভীমেরও কি পুনর্জন্ম হয়নি যে বলতে পারে, যে এই অপমান করেছে, মহাযুদ্ধে আমি তার উরুভঙ্গ করবো, বুক চিরে তার রক্ত পান করবো!
একটা অর্জুনও কি জাতিস্মর হয়ে জন্মায়নি! বস্ত্রহরণের এই অপমানের বদলা নেবার সংকল্প নিতে পারে যে!
নাহ্, নেই। চারিদিকে শুধু অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র। একটু পর পর শুধু জানতে চায়, “কী হলো! কী হলো! “
চারিদিকে বিদূর আর ভীস্মের মতো জ্ঞানী, গুণী জন। নতমস্তকে বসে আছে স্হবির।
চারিদিকে অমাত্য, রাজন্যবর্গ সেলফি তোলায় ব্যস্ত। কে কার আগে আপলোড করবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে।
বেহায়া, ঢঙ্গি পট্টিবাঁধা গান্ধারী জানতে চায়, “সে কি কাপড় চোপড় ঠিকঠাক পরেছিলো। নাকি সেও সিডিউস করার চেষ্টা করছিলো, এদের তো আবার আজকাল মাথা ঠিক নাই!” অন্তপুরের আত্মীয়া, মাতৃস্হানীয় রমণীরা ফিসফাস করছে, “দ্রৌপদীর বড় বাড় বেড়েছে। সে পর্দাপুশিদা মানে না। বড্ড বেহায়া যা হোক। আমাদের কালে বাপু এসব কে কবেই বা শুনেছে! “
কৃষ্ণ ঠাকুরের তো হয়েছে বিরাট জ্বালা! বোন, বন্ধুপত্নী, সখী আগে তো একজনই ছিলো। কলিকালে একেক রূপেই ম্যালা দ্রৌপদী। এদের কয়জনকেই বা সে বাঁচাতে পারবে! অবতার রূপে এমনিতেই তার বদনাম। আজকাল সকল বদমাশরাও তার নাম নিয়ে নানা অঘটন ঘটাচ্ছে, আবার দোষটাও তার ঘাড়ে দিচ্ছে। সে কম বয়সে গোপিনীদের একটু-আধটু বিরক্ত করেছে বটে, তবে সে তো স্নানের সময়! তাই বলে জনসম্মুখে বস্ত্রহরণ! কক্ষণো নয়।
ওসব ওই ছোটো লোক, ইনকিউবেটরে জন্ম নেয়া, বাবা-মায়ের বিগড়ে যাওয়া বখাটে নালায়েক দুর্যোধন-দুঃশাসনদের কাজ।
অবতার হয়েও কৃষ্ণের মাথায় কিছুতেই ঢোকে না এখন তো আর ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির পাশা খেলেন না। গলফ খেলেন।
শকুনী প্রভৃতিরাও টেন্ডার, চাঁদাবাজি, বখরাদারি, সুইস ব্যাংকের হিসাব লুকাতে ব্যস্ত। তবে কার ভুলে, কার পরামর্শে এখনও হাজারো লাখো দ্রৌপদীদের বস্ত্রহরণের পালা চলছে!
দ্রৌপদীও বুঝতে পারে না কিছু। সে শাড়ি পরে, সালোয়ার কুর্তি বা জিনস ফতুয়া পরেই তো সব জায়গায় যায়। উৎসব আয়োজনে চুড়ি, টিপ, মাটির গয়না পরে, সাজে। সবাই সাজে ! তবে কেন তারই এমন হচ্ছে! সে কী তবে এমন কিছু করেছে যাতে দুর্যোধন ভাবছে সেই তাকে আহ্বান জানিয়েছে তার কাপড় ছিঁড়েখুড়ে ফেলে তাকে বেআব্রু করতে!
সে-ই কি তবে দায়ী?
সে কী অপরাধ করেছে বুঝতেই পারে না। সে তো উৎসবে এসেছে। এ তো কোনো দ্যুতসভা নয়। সে তো কোনো অলস, অকর্মণ্য রাজার পাশা খেলার হেরে যাওয়া পণ নয়!
চারপাশে তাকিয়েই তার ভুল ভাঙ্গে। সে যে চক্রবুহ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে, সেখানে আরো অনেক দ্রৌপদীর ভয়ার্ত মুখ। একজনার দুহাতের আঙ্গুলে ধরা দুটি কম্পমান শিশু। সে মিনতি করছে, “আমার সন্তানদের সামনে আমায় অপমান করো না”।
আহ্! কী ভয়ন্কর!
কী বিভৎসতা! সইতে না পেরে চোখে হাত চাপা দেয় সে। প্রচণ্ড শব্দে চমকে আবার চোখ থেকে হাত সরায় দ্রৌপদী। তার পূর্বজন্মের কথা কিছু যেন মনে পড়ে যায়। সেদিনের বস্ত্রহরণে এমন করে তো কেউ বাঁশি বাজায়নি, সকলে ছিলো নিশ্চুপ, নতমুখী!
এমন করে ভিড় করে তো কেউ ঘিরে ধরেনি!
আজ তবে এ কী হচ্ছে?!
আজ কি মহাপ্রলয়ের দিন!
তাই যদি হবে, তবে ওরা হাসছে কেন?
ওরা গোল হয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে ছবি তুলছে ,ভিডিও করছে কেন?
মহাপ্রলয় কি তবে শুধু তারই জন্য?
তাদেরই জন্য! দ্রৌপদীদের শুধু জন্ম থেকে জন্মান্তরে মহাপ্রলয়ের মুখোমুখি হতে হয়!
সে জানে স্বর্গের দ্বার থেকে রাশি রাশি রেশমি কাপড় এসে তাকে ঢেকে দেবে না। তবু কী মনে করে দুহাত জোড় করে চোখ বন্ধ করে সেই প্রচণ্ড শব্দের নরকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
একসময় টের পায় মাত্র দুদিন আগে নামকরা বুটিক শপ থেকে কেনা লাল সাদা শাড়ির আঁচলটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে যাচ্ছে।
*** (সেই যে দুবছর আগে পহেলা বৈশাখে নারী নিপীড়ন হলো, তখন লিখেছিলাম। তাদের যে কী হলো, কেউ জানে?)