সুপ্রীতি ধর:
বহুধা বিভক্ত নারী আন্দোলন লইয়া জাতি কী করিবে? গত কদিন ধরেই এই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে। একটা ঘটনার খবর আমরা কয়েকজন দিলাম, অথচ যারা বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করে দীর্ঘদিন ধরে, তারা কেউ এগিয়ে এলো না? নাকি এজন্য ফান্ড লাগবে? একটা মেয়ের জীবন বাঁচাতে ফান্ড ছাড়া এক পা-ও নড়া যাবে না?
আরও ধরুন, ‘বাল্যবিবাহ ঠেকানো গেল না’ শিরোনামে খবর এসেছে পত্রিকার পাতায়। ঠিক আছে, বিয়েটা ঠেকানো গেল না, কিন্তু তাই বলে মেয়েটাকে ঠেলে দিয়ে রাখবো সেই অতল গহ্বরে? বিয়েটার সাথে সংশ্লিষ্টরা তো হাতের কাছেই আছে, ওদের কেন বিচারের আওতায় আনা গেল না? ওদের তো শাস্তি হওয়া উচিত। আর ‘বিয়ে হয়ে গেছে’ বলে যারা গীত গাইছেন, তাদের বলি, এটা কোনো ব্যাপারই না একটা বিশাল জীবনের কাছে। মেয়েটিকে এ বিয়ের হাত থেকে রক্ষা করা উচিত, এবং তা অচিরেই।
আমরা যখন খবরটি পেলাম যে খোদ রাজধানীর খিলগাঁওয়ে একটি কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে তার চেয়ে বয়সে তিনগুণ এক পুরুষের সাথে, আমরা যথাসাধ্য চিৎকার-চেঁচামেচি করলাম অনলাইনে বসেই। কিন্তু একজন বন্ধু, যে কিনা হাটে-মাঠে-ঘাটে আন্দোলন করে, সে একাই ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই ঘটনায়। নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবলো না একটিবারও। তার সাথে যথেষ্ট খারাপ ব্যবহারও করা হয়েছে, আরও বড় কিছুও হতে পারতো। কিন্তু আমরা যদি দলবল নিয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো এমন ব্যবহার ওরা করতে সাহস পেতো না, আর আমরা ‘মেয়েটিকে সত্যিকার অর্থেই বাঁচাতে পারতাম’।
মানে মেয়েটিকে স্বামীর হাতে তুলে দেয়ার সময়টা কেবল বাড়ানো গেছে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে যে সেই কর্মটি সম্পাদন হবে না, মেয়েটিকে যে বাবা-মাই রাতে ওই লোকের বিছানায় ঠেলে পাঠাবে না আর তার সূত্র ধরে মেয়েটি প্রেগন্যান্ট হবে না, বা সেই মেয়েটিকে তার বাবার বয়সী লোকটির কাছে ইতালি পাঠিয়ে দেয়া হবে না, তার নিশ্চয়তা আমার দিতে পারছি না। যারা দীর্ঘদিন ধরে বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করছেন, তারা যদি একটু গা ঝাড়া দিতেন, তাহলে সম্মিলিতভাবে মেয়েটিকে বাঁচানো ছাড়াও, এই ঘটনায় সম্পৃক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করা যেত। বিয়ে হয়ে গেছে – এটা খুবই খোড়া একটা যুক্তি, মেয়েটার জীবন সামনে পড়ে আছে। আজকের একটা সই তারা সারা জীবনের নিয়ন্ত্রক হতে পারে না।
যারা বিভিন্ন সময়ে এই বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ‘বিশেষ বিধান’ এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, রাস্তায় নেমেছেন, তারা যদি আজ যূথবদ্ধ হয়ে এই একটি ঘটনার সমাধান না করি, যদি ‘বিশেষ দৃষ্টান্ত’ স্থাপন না করি, তাহলে আমাদের আন্দোলন করার কোনো যুক্তি নেই। যেসব সংগঠন বা সংস্থা ঘটনা ঘটার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়, অথচ ঘটনাটা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে অক্ষম হয়, তাহলে তাদের এসব আন্দোলনে কী আসে যায় সাধারণের?
বার বার বলছি, এখানে অনেকগুলো ঘটনা সম্পৃক্ত। পাসপোর্ট অফিসের দায়সারা কর্মকাণ্ড, সিটি কর্পোরেশনের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ দেয়া, মেয়েটির মা-বাবা এবং ওই পুরুষটি, সেইসাথে তার মা-বাবা, এদের সবাইকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরিভাবে প্রয়োজন। একটি ঘটনা দিয়েই কিন্তু কিছুটা হলেও বাল্যবিয়ের ভিতটা নড়ানো সম্ভব।
দিনাজপুরে একটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে, মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে। আমরা এ জাতীয় খবর প্রচার করতে চাই না, যদি না এই ঘটনা প্রতিরোধ করতে না পারি। মিডিয়া কেন ঘটনা সংঘটনের অপেক্ষায় বসে থাকবে? তাদের কি কোনো দায়বদ্ধতা নেই? কেন আজ তাদের আমাদের পাশে পাচ্ছি না? সবাই ‘রাজনীতি’ নিয়ে ব্যস্ত, আর সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মেয়েদের নিয়ে ভাবার সময় কই তাদের? আমরা যারা ঊণ মানুষ, তারাই অপর ঊনদের কথা ভাবি, এটাই প্রমাণ হয়।
আবারও বলছি, যারা বলছেন, মেয়েটার বিয়ে ঠেকানো গেল না, সুতরাং এর ১৮ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রস্তাবে মাথা নেড়ে সায় দেই, তারা ভুল বলছেন। ভেবেছেন, মেয়েটার যখন ১৮ হবে, তখন ওই ৩৭ বছরের পুরুষটির বয়স কিন্তু থেমে থাকবে না। আর আজকের একটা ভুল তো মেয়েটিকে সারা জীবনের মতো দগ্ধ করে রাখবে। তা কেন হতে দেবো আমরা? কী হয়েছে একটা পেপারে সই করেছে বলে?
আমরা কি বলতে পারি না সমস্বরে যে, এ বিয়ে মানি না, এ বিয়ে বৈধ নয়? ভেঙে দিতে পারি না এ বিয়ে? আর যারা পুরো প্রক্রিয়াটার সাথে যুক্ত, তাদের সবাইকে খোয়াড়ে ঢুকানো উচিত, উচিত সাজা দেয়া দরকার ওদের। তাহলে যদি অন্যরা কিছুটা হলেও সাবধান হয়!
এখন ভাবুন, কী করবেন আপনারা? আমরা সকলে মিলে ওই এলাকায় যাই চলুন, মেয়েটির বাড়িতে যাই, ছেলেটির বাড়িতে যাই, সিটি কর্পোরেশনে যাই, থানায় যাই। চলুন। এটা তো শুধু নারী আন্দোলন কর্মীদের দায়িত্বই নয়, এটা সবার দায়িত্ব। বিষয়টা সামাজিক এবং যথারীতি রাজনৈতিকও। সুতরাং সেভাবেই এর সমাধান চাই। সবার অংশগ্রহণ চাই।