নারী ভাস্কর্য বা মূর্তি হোক, কামেরই প্রতিরূপ

সেবিকা দেবনাথ:

একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করি। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন জাতীয় জাদুঘরে প্রায়ই যাওয়া হতো। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে গেলেই দেখতাম মূর্তিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে অনেকে মুখ টিপে টিপে হাসে। তারা হাসতেই পারেন। ওখানে ‘হাসতে মানা’ এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বয়সভেদে অনেক ছেলেদেরই কয়েকবার দেখেছি জাদুঘরে রাখা মূর্তির গায়ে হাত দিতে। হাত বুলিয়ে মূর্তির সৌন্দর্য্য তারা দেখেনি। পাথরের দেবী মূর্তির ‘স্তন’ ছিল তাদের আগ্রহের বিষয়। সেখানে হাত বুলিয়ে তারা কোন সুখ খোঁজার চেষ্টা করে, বা করেছে, তা আমি জানি না।

দূর্গা প্রতিমার শারীরিক গঠন নিয়ে অনেকেই ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন। কালী প্রতিমার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমি এমনও শুনেছি, প্রতিমা দর্শনেও নাকি কারও কারও কাম ভাব জাগে। কেউ কেউ কৌতুহলবশত প্রশ্নও করেন, দেবী সত্যিই এতো আবেদনময়ী (সেক্সি) ছিলেন কিনা! বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেরা দল বেঁধে প্রতিমা দেখতে গিয়ে এসব আলোচনা করে। মাটি দিয়ে প্রতিমার অবয়ব ফুটিয়ে তোলার পর তা দেখে কেউ কেউ উলঙ্গ নারীর সঙ্গে সেই প্রতিমার মিল খুঁজেন।

এসব নিয়ে যখনই বন্ধু মহলে কথা বলেছি, তখনই অনেকে উদাহরণ টেনেছেন সরস্বতীর প্রতিমা দেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে কামনা জাগার বিষয়টি। আমি পূণ্যবান নই, সরাসরি তো দূরের কথা, স্বপ্নেও কখনো দেবী দর্শনের সুযোগ বা সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাই আমিও ঠিক জানি না দেবী আসলে দেখতে কেমন ছিলেন! আসলেই তিনি ছিলেন কীনা!

তবে আমার ভাবতেই অবাক লাগে যে, এতো স্থূল ভাবনা কীভাবে মানুষ ভাবতে পারে! অশ্লীলতারও তো একটা সীমা থাকে। আমরা সেই সীমাও পেরিয়ে গেছি। গত বছরই খুব সম্ভবত এই উইমেন চ্যাপ্টারেই একটি ঘটনার কথা জেনেছিলাম। আমাদেরই কিছু উঠতি বয়সী ছেলে একটি নারী ভাস্কর্যের স্তনে হাত বুলাচ্ছে, মুখ দিয়েছে এবং সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে বেশ বড়াই করে অশ্লীল মন্তব্য করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘটনা জানাজানি হলে এবং এ নিয়ে লেখালেখির পর ওই ছেলেরা ছবিগুলো শুধু ফেসবুক থেকে প্রত্যাহার করেই পার পায়নি, তাদের মা-বাবা পর্যন্ত গিয়েছে এবং ছেলেগুলো উইমেন চ্যাপ্টারের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে। এসবই খুব সাম্প্রতিক ঘটনা।

সম্প্রতি সুপ্রীম কোর্টের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য নিয়ে দেশে তোলপাড় চললেও প্রধানমন্ত্রীর এক মন্তব্যে সেখানে ভাটা পড়েছে বলেই বোধ হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে, সেই ভাস্কর্য (কারও কারও ভাষায় ‘মূর্তি)  দেখেও কি কারও কারও মনে এমন কাম ভাব জেগে ওঠে? সে জন্যই কি ওই নারী ভাস্কর্যকে সরিয়ে নিজেদের কু-প্রবৃত্তিকে সংযত করতে চাওয়া? ওই ভাস্কর্যে বিশেষ পোশাক চাপিয়ে দিতে চাওয়া? তাই যদি না হবে, তবে দেশের সব ভাস্কর্যেই কেন ওই বিশেষ পোশাক পরানো হবে না? সেগুলো পুরুষ ভাস্কর্য বলে? সেগুলো দেখলে কাম ভাব জাগে না বলে? নাকি নারীরা তাদের কামভাব নিয়ে বলে না বলে? আর ওই গ্রিক দেবীকে বিশেষ পোশাক পরলেই কি কাম ভাব কর্পূর হয়ে উবে যাবে? সমস্যাটা এতো উগ্র কেন? নারীমাত্রই কামের প্রতিরূপ?

দেশের কিছু পুরুষ এতো বেশি কামুক হয়ে গেছে বলেই এই দেশে দুই/তিন মাসের শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। তাতেও ক্ষান্ত হয় না ওই কামুক পুরুষ। ব্লেড দিয়ে ওই শিশুকে চিড়ে বিকৃত যৌনতার পরিচয় দেয়। বয়সের বিভেদ ভুলে নিজের বিকৃত যৌনতাকে প্রাধান্য দেয় যে পুরুষ তাদের কাছে প্রতিমা, ভাস্কর্য কিংবা রক্তে মাংসের নারী কেউ-ই নিরাপদ নয়। তবুও তারা পুরুষত্ব নিয়ে বড়াই করেন। নিজের পুরুষত্ব ফলাতে চান সবখানে।

আমি তো দেখি, সমস্যাটা আসলে পুরুষের নিজের, তার দৃষ্টির, তার মানসিকতার, তার বেড়ে উঠার, আর সবশেষে তার ধর্মের। সেখানে জোগালি হয় রাষ্ট্র, ছড়িয়ে পড়ে অন্ধত্ব, এবং তাই হচ্ছে।

এর শেষ কোথায়?

শেয়ার করুন: