গোপন প্রেমের ভাবনা

দিনা ফেরদৌস:

ভাবনায় কত কী কাজ করে! ভাবনাগুলোর ভাবনাতেই উৎপত্তি, আবার ভাবনাতেই নিষ্পত্তি হয়। এক সময় ভাবতাম বিয়ে, সংসার আমারে দিয়ে হবে না। আর মনে মনে অহরহ প্রেমে পড়তাম। প্রেমে পড়লে প্রেম করতে হয়, প্রেম করলে বিয়ে। বিয়ে করলে সংসার, বাচ্চা সব আটোমেটিক, যেন হিসাবটা ছিল এই।
প্রেমে পড়তে পড়তে একবার প্রেম করলামও। অনবিজ্ঞ থাকায় প্রথম প্রেমে সাকসেসফুল হতে না পারলেও সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয়বারের প্রেম বিয়ে থেকে সংসার পর্যন্ত গিয়ে গড়ালো। কিন্তু এখানে যেহেতু অভিজ্ঞতা নেই, তাই প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। কোনো কিছুই অটো হয় না। বিয়ে মানে শুধু স্বামীর সঙ্গে পুতু-পুতু প্রেম না, ওটা হচ্ছে শ্বশুর বাড়ি। ওখানে বাড়ির ছোট-বড় থেকে শুরু করে কাজের বুয়া,পরিচিত সবজিওয়ালা, এমনকি ঘরের জানলা দিয়ে যে প্রতিবেশিকে চোখে পড়ে, তাকেও সমীহ করে চলতে হয়। বিয়ে সংসার মানে হাজারটা নিয়মের সমষ্টি।
একসময় সবই সয়ে নিতে হলো। সংসার, বাচ্চা সব হলো। তারপরও মনের মধ্যে কাজ করে, কী যেন কি নেই। বুঝতে পারলাম প্রেম প্রেম ভাবনাতে এইসব ঝামেলা থাকে না বলেই, ভাবনাতে এতো মজা। একারণেই হয়তো শুধু প্রেমের প্রতি আমার অসম্ভব এক দুর্বলতা আজন্মই কাজ করে ভিতরে ভিতরে।

আবারো ভাবনাতে ফিরে যাই। মেয়ে মানুষের প্রেম কি আর এতো সহজ ব্যাপার! পুরুষ মানুষ হলে না হয় কৃষ্ণলীলা, বা প্লেবয় বলে চালানো যায়। মেয়ে মানুষের প্রেম বিয়ে পর্যন্ত না গড়ালে হয় কলঙ্কিনী রাধা, বা নষ্টা মেয়ের খেতাবে ভূষিত হতে হয়। এজন্যই গুরুজন বলেন, দেইখ্যা-শুইন্যা প্রেম করো। আর আমি বলি, প্রেম যদি দেখে-শুনেই করতে হয়, তো বাবা-মা দেখে দিলে দোষটা কোথায়? ছেলে শিক্ষিত, সুদর্শন, ভাল চাকুরী, ঝকঝকে বাড়ি, গাড়ি, ভালো বংশ মর্যাদা, বিশাল কাবিন, পরিবার তো এই সবই দেখে দেয়।

ছেলের পরিবার দেখবে, শিক্ষিত কম বয়সের মেয়ে, দেখতে সুন্দরী, বাপ-ভাই আছেন, মোটা অংকের যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে পারবে মেয়ের বাপ ইত্যাদি, ইত্যাদি। নিয়মের মধ্য দিয়ে গেলে সব মানতেই হয়। যা হচ্ছে দর কষাকষির বাজার।
এতো গুণ যেহেতু আমার মধ্যে কোনো কালেই ছিল না,তাই আঙ্গুর ফল টক বলে শুধু একটি প্রেমের স্বপ্নই আঁকি মনে মনে। ভাবতে ভাবতে মনে হয় কোনো কারণ ছাড়াই একদিন কোথাও বেড়িয়ে পড়বো। দূরে কোথাও। অপরিচিত কোনখানে। চাকরি বাকরি না পেলে হাঁস-মুরগি পালন করবো। কী দরকার ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে আমার ভাবার? সব চলছে যেমন চলুক। আবার মনে হয়, যাবো’টা কোথায়? একা একটি মেয়েকে দেখে লোকজন প্রশ্ন করবে না এমনকি হতে পারে?
বাড়ি ভাড়াও তো দিতে হলে হাজারটা প্রশ্ন। বিয়ে হলো না কেন, বিয়ে হলে স্বামী কই, সংসার কই, কী কারণে একা থাকতে হয়? আরো গভীরে যাই। এই একাকিত্বের সুযোগ নিতে আসবে না তো কেউ কেউ! সুযোগ না দিলে অপমান করবে না তো! কিংবা মেরে ফেলে রাখবে না তো কোন ঝোপঝাড়ে? উহ্ আর ভাবতে পারি না। রোমান্টিক চিন্তারা পালাতে শুরু করে। কোথাও নিরাপদে শান্তিতে থাকার সুযোগ নেই।
এক কথায় সব জায়গায় যুদ্ধ করে থাকতে হবে। ঘরে বাইরে সবখানে।

সেইসব অযাচিত ভয়, প্রশ্নের পাশ না হয় কাটিয়ে গেলাম। কিন্তু অযাচিত কিছু উত্তর, আমার মতো হয়তো অনেকের জীবনেই আসে, যা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, তখন পরিচয় হয় সেইসব উত্তরদাতাদের সঙ্গে। মেয়েদের ঈমান ভালো থাকলে ভালো পাত্র ভাগ্যে জুটে। আমল ভালো করলে কোন দাবি-দাওয়া ছাড়াই পাত্রপক্ষ পছন্দ করে। মেয়েদের বয়স বিশ হওয়ার আগেই বিয়ে দিলে ভাল সংসারী হয়। বয়স বেশি হয়ে গেলে চেহারা ছবি নষ্ট হয়ে যায়, কেউ ফিরেও তাকায় না। বেশি পড়ালেখা করলে যোগ্য পাত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যা শুনলেই মনে হবে মেয়েদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বিয়ে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নারীরাই এই জাতীয় গল্প করেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই বিয়েই এদের কারো কারো জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সামাজিক কারণে নামমাত্র সংসার করেন। স্বামীর ডানে- বামে তাকানোর অভ্যাস আছে, কেউ বাপের বাড়ি থেকে আনতে পারেন বলে সংসারে টিকে আছেন। কেউ কেউ মাইরও খান নিয়ম করে। তারা জানেন এসব প্রকাশ করতে হয় না সমাজে। তারা জানেন এসব প্রকাশ করলে এই সমাজের জ্ঞানী- মূর্খ সবাই পুরুষ হয়ে যান, আর নারীরাও করেন সেইসব পুরুষদের প্রতিনিধিত্ব। এক হয়ে বলেন, ঘরের কথা বলতে নেই। এতো ব্যক্তিগত কথা প্রকাশ করতে নেই। এইসব প্রকাশ করলে তাদের কতো নোংরাভাবে কটাক্ষ করা হয়, তারা তা জানেন।
কেউ কেউ সহজ সমাধানও দেন ‘না পোষালে বিদায় হও। বিদায় হলে যাবে কোথায়, থাকবে কোন সমাজে তিরষ্কার ছাড়া, তার সমাধান কেউ দেন না। পড়ালেখা জানা স্বাবলম্বী মেয়েরা যেখানে ফাইট করতে ভয় পায়, সেখানে সাধারণদের নিন্দা করতে ইচ্ছে হয় না। যারা এতো কিছুর সঙ্গে ফাইট করে নিজের মতো করে বাঁচতে পারেন, তাদের আমি অসাধারণ-ই মনে করি এজন্যই।

এই যে ভাবনাগুলো নিয়ে লিখছি, জানি না কঠিন পরিস্থিতি এলে নিজে কী সিদ্ধান্ত নেবো! 

আমার কখনো কাউকে বলার সাহস হয়নি যে শুধু প্রেম করেই জীবন পার করতে চাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম কোনো একদিন। নো সংসার, নো বাচ্চা -কাচ্চা। যখনি মন চাইবে প্রেমিকের কাছে ছুটে যাবো। হেঁটে হেঁটে চানাচু্র খাবো, সিনেমা দেখতে যাবো, খুব কাছ থেকে নাক ঘেঁষে পুরুষালী ঘ্রাণ নেবো। বলেছি, তবে যা বলতে চেয়েছি, বলেছি ঠিক তার উল্টো। সব মানুষের ভয়ে, সমাজের ভয়ে বলতে হয়েছে। সেই ভয় থেকে এক ধরনের ঘৃণার জন্ম হয়েছে ভিতরে টের পাই। এতো ভণ্ডামি আর ভাল্লাগে না।
এখন প্রাণ খুলে চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, হ্যাঁ, আমি প্রতিদিন কোন না কোনভাবে প্রেমে পড়ি। আমি প্রেমে পড়ি। আমি প্রেমে পড়তেই ভালবাসি। যার যা ইচ্ছা আমাকে নিয়ে ভাবতে পারো। 
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.