যারিন তাসনীম:
নারী মানেই ১২ হাত কাপড়ে ঢেকে রাখা খাদ্যবস্তু এটা ছোটবেলা থেকেই প্রতিটা মেয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। প্রতিটা মেয়েকে বলে দেয়া হয়, “তোমার পাজামা টাখনুর উপরে উঠানো যাবে না, তোমার বুকের কাপড় সরানো যাবে না, বাইরে বেরুলে মাথায় কাপড় দিয়ে যাবা, তাহলে লোকে ভদ্র, মার্জিত মেয়ে মানুষ বলবে।”
এই যে সমাজে নারীদের যে একটা ভদ্র, মার্জিত একটা রূপ বসিয়ে দিয়েছে যেখানে নারীকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হয়, এই ভদ্রতার আসন কিন্তু শুধু পুরুষ একা বানায়নি, নারীরাও তাতে মদত দিয়েছে। নারীর পর্দা নিয়ে কথা উঠলে অনায়াসে অধিকাংশ মানুষই তেঁতুল হুজুরদের মতোন করে গড়গড় করে বলে যান, “কলা ছিলে রাস্তায় বিক্রি করলে কি কেউ সেই কলা খাবে? কলা ছিলে রাখলে তো মাছি বসবেই। ” “তেঁতুল দেখলে সবার মুখেই পানি আসে “। এহেন কথাবার্তায় তারা বুঝাতে চায় নারী কলা এবং তেঁতুল সমতুল্য। এরা নিতান্তই খাদ্যবস্তু। পুরুষেরা যেনো এদের ঠিকঠাকভাবে ভোগ করতে পারে তাই এদের ঢেকে থাকতে হবে।
শুধু যে পুরুষেরা এই ধারণা পোষণ করে, তা কিন্তু না। বাদ যায় না নারীরাও। নারীরাও নারীদের “ঢেকে থাকো ” বিদ্যায় পারদর্শী করার জন্য সমান তালে তাল মেলাচ্ছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ফেসবুকে হাঁটু বেরিয়ে আছে এমন ছবি আপলোডানোর পর আমার এক আত্মীয় আমাকে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করলো, আমার কাছে অড লাগছে না নাকি? এই ধরনের ছবি দেয়া যাবে না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পুরুষের হাঁটু বের করে ছবি দেয়া কি এলাউড?
সে জবাব দেয়, কী এলাউড, আর কী না এলাউড সেটা দিয়ে কাজ নাই, যেটা এলাউড সেটাই আমাদের করতে হবে।
বাহ! চমৎকার! এই যে একটা মানসিকতা মেয়েরা পোষণ করছে, যা এলাউড তাই মেনে নিতে হবে – এটাই কি মেয়েদের পিছিয়ে থাকার আরেকটি কারণ নয়? যদি তাই হতো, যা এলাউড তাই মেনে নিয়ে চুপ করে বসে থাকতে হতো, তাহলে কি আদৌ আমরা মেয়েরা ঘরের বাইরে পা ফেলে বুক ভরে সতেজ বাতাস নিয়ে হাতে বই কলম নিয়ে স্কুলের পথ মাড়াতে পারতাম?
আমরা কি ভুলে গেছি বেগম রোকেয়া সমাজের নিয়ম ভেঙে লড়াই করে আমাদের শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে গেছেন? কিন্তু আসলেই আমরা এতোগুলো বছর পেরিয়ে এই ডিজিটাল যুগে কতোটুকু শিক্ষিত হতে পেরেছি? না না, শিক্ষিত বললে ভুল হবে, “সুশিক্ষিত” হতে পেরেছি? এতোগুলো বছর পেরুলো, আমরা স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির গণ্ডি পেরুলাম অথচ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেই পুরনো বছর গুলোতেই আটকে আছে। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে বলে, “এই তোমার মাথায় কাপড় নেই কেনো? সালোয়ার কামিজ পড়তে পারো না? স্লিভলেস পড়লে তো ঐ মেয়েটারে বাজারের মেয়ের মতো দেখায়, হাঁটুর উপরে কাপড়! লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বসে আছো নাকি?”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে,
মেয়েদের হাঁটুতেও কি যৌনতা থাকে? মেয়েটা স্লিভলেস পরলো, হাত বেরিয়ে আছে। এখন মেয়েটার পুরো হাতটাই কি খাদ্যবস্তু? মেয়েদের প্রতিটা অঙ্গই কি যৌনাঙ্গ সমতুল্য? কই পুরুষের হাত, পুরুষের পা নিয়ে তো কেউ কোনো কথা বলে না! এই যে শুধুমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই “ঢেকে থাকো” মানসিকতাটা এটা কি শুধু পুরুষ একাই তৈরি করতে পেরেছে? এখানে কি নারীদের মদত নেই?
অবশ্যই আছে। পুরুষের এই “ঢেকে থাকো” মানসিকতাটাকে যদি প্রত্যেকটা মেয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিবাদ জানাতো, তাহলে কোনো পুরুষই নারীকে খাদ্যবস্তু ভাবার সুযোগ পেতো না, আর হয়তো আজ এই লেখাটাও লিখতে হতো না। পুরুষকে সকল কিছুর অধিপতি এই আমরাই বানিয়েছি। একটার পর একটা অন্যায় মেনে নিয়ে আমরাই তাদের পুরুষ বানিয়েছি। নয়তো ওরা, আমরা সকলে মানুষই থাকতাম। যে পুরুষটা বাসে ব্রা এর বেল্টে হাত ঘষাঘষি করে, তাকে আমরা সজোরে কয়েকটা থাপ্পড় না দিয়ে পরদিন থেকে বেশ মোটা কাপড়ের একটা বোরখা গায়ে চাপিয়ে বাসে উঠি।
ভাবতে থাকি, আমার দোষেই আমার গায়ে পরপুরুষ হাত দিয়েছে। এই যে একটা অপরাধবোধ মনে উঁকি দেয়, এটা কিন্তু শুধুমাত্র মেয়েদের ক্ষেত্রেই হয়। ছেলেদের যে আধুনিক ফ্যাশনের নামে জাঙ্গিয়া বের করে প্যান্ট পরা হয়, তখন কিন্তু কোনো মেয়ে জাঙ্গিয়া ধরে টানাটানি করতে যায় না। আর যদি কখনো কোনো মেয়ে যায়ও, তাহলেও কোনো ছেলের মনে অপরাধবোধ জন্মাবে না। বরং তাদের ধারণা হবে, মেয়েটা “বেশ্যা” শ্রেণীর। তাহলে? তাহলে কেনো মেয়েদের মনে অপরাধবোধ জন্মায়? এই অপরাধবোধ ঝেড়ে প্রতিবাদ করার শক্ত মনমানসিকতাই কিন্তু এইসব নিয়ম ভেঙে দিতে পারে।
মেয়েদের হাত, পা নিতান্তই হাত, পা। এটা যৌনাঙ্গ নয় যে বেরিয়ে থাকলে ছিঃ ছিঃ করতে হবে। লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার দায়িত্ব সকলের। নারী পুরুষ সকলেই তার লজ্জাস্থান ঢেকে রাখে। কিন্তু এই যে নারীর ক্ষেত্রে তার হাত পা সমেত লজ্জা স্থান ধরা হচ্ছে, এই কাজ শুধু পুরুষ একা করছেন না, বরং নারীরাও সমান তাল মেলাচ্ছে। নারীরা এই তাল মেলানো বন্ধ করে প্রতিবাদের ঝড় তুললেই নিয়ম ভাঙবে। নারী, পুরুষ সকলে মানুষ হবে।