অনন্যা নন্দী:
কয়েকদিন অাগে পিএইচডি করা এক অাপু ফেসবুকে লিখেছে, “অামি অামার বাবার কাছে ছেলের মতো”। কেবল ঐ অাপুই নয়, এমন অনেক মেয়েকে দেখেছি ভাল চাকরি করলে, মা-বাবার দেখাশোনা করলে বা অন্য কোনো সাহসিকতার কাজ করলেই নিজেকে পুরুষের সমকক্ষ বলতে বা ভাবতে গর্ববোধ করে।
হুম, অামিও বুঝি তারা নিজেকে ছেলে বলতে অাসলে ছেলের মতো কাজ করাকেই বুঝাচ্ছে। এতে কি প্রকাশ্যে তারা এটাই বুঝাচ্ছে না যে মা-বাবাকে দেখাশোনা করা বা কোনো সাহসিকতার কাজ কেবল ছেলেরাই করে? মেয়েদের কাজ এসব নয়?সন্তান হিসেবে মা-বাবাকে দেখাশোনা করা বা উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করে ভাল প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে কাজ করা কি মেয়েদের দ্বারা সম্ভব নয়?
বিমান চালানো, বন্দুক চালানো, পর্বতারোহন, মহাকাশ অভিযান ইত্যাদি সব কাজেই তো মেয়েরা অংশগ্রহণ করছে। সংখ্যায় কম হলেও মেয়েরা যে দুঃসাহসিকতার কাজ করতে পারে সেটা তো এরই মধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে। বহু মেয়ে অাছে যারা বিয়ের পরেও মা-বাবাকে সাথে রেখে দেখাশোনা করছে। তবে কেন এসব কাজ করার পর অামরা মেয়েরাই নিজেদেরকে “মা-বাবার ছেলে” বলতে অাগ্রহ পাই?
অনেক ছেলেও কিন্তু দেখা যায় যে, বাসায় রান্না করে, কাপড় ধোয়। কিন্তু তারা তো কোনোদিন নিজেকে “মা-বাবার মেয়ে” দাবি করে গর্ব করে পোস্ট দেয়নি? কারণ হয়তো যে, তারা জানে মেয়ে হওয়া অসম্মানজনক। ছেলেরা নিজেদের অর্জন কিংবা পারিবারিক দায়িত্ব পালন করাটাকেই জীবন মনে করে। তাদের কাছে এগুলো কোনো অাহামরি কাজ নয়।কিন্তু সমস্যা অাছে অামাদের মেয়েদের মানসিকতায়। রান্না করা এবং সংসার করা ছাড়া ব্যতিক্রম কিছু করলেই অামরা নিজেকে ছেলে ভাবতে বা জাহির করতে ভালবাসি। অামরা কখনই ব্যতিক্রম কিছু করাটাও যে মানুষ হিসেবে অামাদের দায়িত্ব, তা ভাবতেই পারিনা।
একটা মেয়ে কখনই ভাবে না যে তার ভাইটা যা করছে সেটা করা তারও দায়িত্ব। অনেক মা-বাবা দেখি খুব বেশি অাদর করে সবাইকে বলে, “অামার মেয়ে তো অামার কাছে ছেলের মতোই।” এর মানে এই দাঁড়ায়, ছেলে পরম অারাধ্য এবং অাদর যত্নের পাত্র। মেয়ে বলাটা এই সমাজে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বুঝায়। অামার এক ভাবী খুব গর্ব করে বলছিল সেদিন, “অামার শাশুড়ি তো অামাকে তার ছেলের মতো ভালবাসে।”
অামি পাল্টা প্রশ্ন করলাম,”তার মানে তোমার শাশুড়ি তুমি সবার শেষে ঘুম থেকে উঠলেও রাগ করে না! তুমি সবার অাগে খেতে বসলে তোমাকে পাখার বাতাস করে খাওয়ায়?” এই প্রশ্ন শুনে বেচারীর অাদরে অাটখানা মুখটা পাংশু হয়ে গেলো।
মেয়েদেরকে ছেলে বলুক বা ছেলের মতোই বলুক, কোনোটাই বলা উচিৎ না। ছেলেদেরকে মেয়ের সাথে তুলনা না করলে মেয়েদেরকে ছেলের সাথে তুলনা করাটা অামি মেনে নিতে পারি না। এই ব্যাপারে অামাদের মেয়েদেরও সচেতন হতে হবে।অামাদের মানসিকতার পরিবর্তন অানতে হবে। পর্বতারোহণ, মহাকাশ জয়, বিমান চালানো, বা পিএইচডি করা এবং বিয়ের অাগে ও পরে মা-বাবাকে দেখাশোনা করা মানুষ হিসেবে অামাদেরও দায়িত্ব। এবং অামাদেরও তা করার সামর্থ্য অাছে।
তাহলে অামরা কেন উপরোক্ত কাজগুলোকে “ছেলের মতো কাজ” বা “ছেলেদের কাজ” বলে ট্যাগ লাগাচ্ছি? নিজেদেরকে ছেলের সাথে তুলনা বা ছেলের মতো বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট কেন বলবো? অামরা কি অামাদের মতো হতে পারি না? মেয়ে হওয়া নিয়ে অামাদের এতো অসন্তোষ কেন?
প্রকৃতপক্ষে অামরা তো ছেলেদের চাইতে বেশি পাওয়ারফুল। অামরা “মা” হতে পারি। অামাদের মাধ্যমেই মানবজাতির বংশবিস্তার। ২৮০ দিন সন্তান শরীরে রেখে বাস করতে অামরাই পারি। প্রসব বেদনা সহ্য করাও মেয়েদেরই কাজ। অামরাই অাবার দেশ চালাতে পারি, যুদ্ধ করতে পারি।
বিবেচনা করলে তো অামরা মেয়েরাই অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন। তবে কেন এই তুলনা? অামাদেরকে নিজেদের ক্ষমতা বুঝতে হবে। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে বিশ্ব জয় করতে হবে। অামরা কোনো ছেলের সমান নয়, ছেলের চাইতে বেশি কিছু করতে হবে। মেয়ে নয়, মানুষ হিসেবেই সমাজে পরিচিত হতে হবে। ছুঁড়ে ফেলতে হবে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার অসন্তুষ্টি।
শেয়ার করুন: