একটি বাচ্চা মেয়েকে বাঁচাতে পারলাম আপাতত

সুপ্রীতি ধর:

আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় ছোট্ট একটি মেয়েকে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ এর হাত থেকে আপাতত রক্ষা করতে পেরেছি। তাই একটু হলেও আনন্দ লাগছে। জানি না, আমাদের এই সাফল্য ঠিক কতোদিন বা কতোক্ষণ ধরে রাখতে পারবো? মেয়েটি কতোক্ষণ এই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে পারবে? অনেক আশংকা, আতংকও কাজ করছে একই সাথে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬ এর ‘বিশেষ বিধানের’ আওতায় যদি পড়ে যায় মেয়েটি? 

মূল ঘটনায় আসি-

গত চার-পাঁচ দিন ধরেই আমরা মানে প্রথমে আমি আর প্রভা এই বিষয় নিয়ে বিচলিত ছিলাম। একটা বাচ্চা মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী ইতালি প্রবাসী একজনের সাথে, এমন একটি খবর আসে আমাদের দুজনেরই ইনবক্সে। দুজন দুজনের সাথে শেয়ার করি। সিদ্ধান্তে আসি খিলগাঁও থানায় খবর দেবো। কিন্তু পরদিন নানান ঝামেলায় ভুলে যাই। দুদিন পর প্রভা এ নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ায় মনে পড়ে যায়। এবং ত্বরিৎগতিতে সেই স্ট্যাটাসটি শেয়ার দিয়ে প্রথম আলোর শরিফুল হাসান আর মানসুরাকে ট্যাগ করি। ভাবি যে, আমার তো কোনো শক্তি নেই। ওদের সহায়তা লাগবে। তাতেও শান্তি না মেলায় হাসানকে ফোন করি। হাসান আমাকে ছেলেটি এবং মেয়েটির বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করতে বলে। আমি আর প্রভা চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। প্রচণ্ড এক অস্থিরকাল পার করেছি সেই সময়টাতে। 

এদিকে প্রভার স্ট্যাটাস পড়ে আমাদেরই আরেক বন্ধু, সংগ্রামের-আন্দোলনের সাথী, খোজিস্তা বেগম জোনাকী নিজেই উদ্যোগী হয়ে মেয়েটির বাসায় চলে যায়। সেই কাহিনী নিয়ে মূল লেখাটি জোনাকি নিজেই লিখছেন। জোনাকি যেহেতু প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে জড়িত, তিনি দ্বিতীয় কোনো ভাবনার অবকাশ না দিয়েই, এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথাটা মাথায় না এনেই সোজা চলে গেছেন সেই বাড়িতে, মানে মেয়েটির বাড়িতে।

খোদ রাজধানী শহরের খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ায় ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছিল। ১৩ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েটি সবে ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে। তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল ইতালি প্রবাসী একজনের সাথে, যার বয়স কাগজপত্রে লেখা হয়েছে ৩৫ বছর। আকদ আগেই হয়ে গেছিল। 

বিয়ের কথা ছিল পহেলা বৈশাখের পরদিন, আর বৌভাত তার পরেরদিন। এখন এসব হুমকি-ধামকি দিয়ে মূল বিয়েটা রুখতে পেরেছি ঠিকই, কিন্তু মেয়েটির পাসপোর্ট যেহেতু রেডি, ভিসাও লাগানো শেষ, কাজেই তারা যে রাতের অন্ধকারে মেয়েটিকে প্লেনে তুলে দেবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

সরকার এক আইন করেছে বিশেষ বিধান রেখে, এখন আমরা কয়টা মেয়েকে এভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করবো? আমাদের বিবেক এখনও কোথাও বন্ধক রাখিনি বলে হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বো, কিন্তু কতোক্ষণ? আদৌ বাঁচাতে পারবো মেয়েগুলোকে? রাজধানীতে বাস করা, বাবা-মা সরকারি চাকরি করা, এমন একটা পরিবারে যদি এভাবে মেয়ের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে গ্রামের মানুষদের কথা একবার ভেবে দেখলেই তো গা শিউড়ে উঠছে।

এদিকে আরও একটি বিষয় হচ্ছে, মেয়েটির পাসপোর্ট হয়ে গেছে বিয়ের আগেই। যেখানে তাকে বিবাহিত দেখানো হয়েছে বলে আশংকা করছি। এখন প্রশ্ন হলো, পাসপোর্ট করার সময় তো পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। তো, পুলিশ এক্ষেত্রে কী ভেরিফাই করেছিল? মেয়েটিকে দেখে কি তাদের একবারও সন্দেহ হয়নি যে, মেয়েটির বিয়ের বয়স হয়নি? আর বিবাহিত দেখানো হলে তারা কি কাবিননামা দেখতে চায়নি? এটা কেমনতরো ভেরিফিকেশন হলো? অথচ আমার বাচ্চার পাসপোর্ট করার সময় মনে আছে, পুলিশ আমার কাগজপত্র ফেরত পাঠিয়েছিল ঠিকানা পায়নি রিপোর্ট দিয়ে। কারণ ওদের যে বাংলা নাম (খটোমটো মনে হয়েছিল পুলিশের কাছে), সেই নামে কেউ তাদের চেনেনি আমার এলাকায়। 

খিলগাঁওয়ের মেয়েটির ক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় কমিশনার, পুলিশ সবাইকে সম্পৃক্ত করেছি। প্রভা প্রধানমন্ত্রী অফিসে কথা বলে তাদেরকে ইনফর্ম করেছে। তারা প্রভা এবং মানসুরা দুজনকেই আশ্বাস দিয়েছিল যে, বিয়েটা হয়ে গিয়ে থাকলেও মেয়ের বাবা-মা যেহেতু সরকারি চাকরি করে, কাজেই কোনো একটা পদক্ষেপ নেয়া যাবে। আমরা এইটুকু আশ্বাস পেয়েই খুশি। আমরা এটাও ভেবেছি, যদি শেষপর্যন্ত মেয়েটিকে নিয়ে চলেই যায় ইতালি, আমরা সেখানেও ওকে ধরবো। আমরা জীবনপণ করেছি মেয়েটাকে বাঁচাবো বলে, জানি না শেষরক্ষা হবে কীনা! মেয়েটিও বলেছে, তার ইচ্ছা নেই বিয়েতে, কিন্তু তার নানুর কারণে রাজী হয়েছে।

এ কারণেই প্রভা আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, মেয়েটির মত থাকলে কি আমরা তা ফেরাতে পারবো? আইনটা আমার পড়া হয়নি, কিন্তু ধারণা থেকে বলি যে, একটি শিশুর বিয়েসংক্রান্ত মতামতকে কেন গুরুত্ব দিতে হবে? তাছাড়া এই বয়সে বিয়ে নিয়ে একধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করে মেয়েদের ভিতরে, তাকে আমলে নেবো কেন? ও কী বোঝে নিজের জীবনের? বাড়িভর্তি মেহমান, রঙীন বাতিতে উজ্জ্বল চারদিক, বেশ একটা সাজ সাজ রব চারদিকে, একটা কিশোরী মেয়ের অংকুরোদ্গম শরীরে কিছুটা খেলা তো খেলেই এই বিয়ে নামক বিষয়টা। তাই বলে তাকে তো আমরা ঠেলে দিতে পারি না। 

জোনাকি জানায়, ও যখন মেয়েটির বাড়িতে যায়, তখন স্থানীয়রা এসে ভিড় করেছিল। সবাই এই বিয়ের বিরুদ্ধেই মতামত জানিয়েছে। মেয়েটিকে দেখে সবাই একমত হয়েছে যে, এটা কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু এই যে উপলব্ধি, এতো হালে পানি পাবে না টাকার অংকের কাছে। দরিদ্র বাবা-মা কতোক্ষণ নিজেদেরকে আগলে রাখতে পারবেন এই লোভ থেকে? বা তাদের ভাষায় ‘মেয়ের নিশ্চিত বিদেশ জীবন’ থেকে?

কতোকিছুই না আমরা ভেবেছি, এবং এখনও ভাবছি। একজন ৩৫ বছর (কাগজ অনুযায়ী, আসল বয়স নাকি আরও বেশি) বয়সী মধ্যবয়সী লোক কেন ১৩ বছরের কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করবে? এটাই হয়তো তার প্রথম বিয়ে নয়? তাহলে কী মেয়েটিকে সে কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে বিয়ে করে? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এসব আশংকার কোনোটাই কিন্তু অমূলক নয়। 

আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই, বুকভরা সাহস আর সততাটুকু ছাড়া। এইটুকু নিয়েই আজ আমাদেরই একজন নিজে উদ্যোগী হয়ে, অনেক সাহস নিয়ে একাই একটা বাড়ির ভিতরে ঢুকে লড়াইটা করে এসেছে। এবং শেষপর্যন্ত দুপক্ষের বাবা-মায়ের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে যে, মেয়েটির বয়স ১৮ না হওয়া পর্যন্ত তারা ওর বিয়ে দেবে না। পুলিশ এবং কমিশনারও কথা দিয়েছেন বিষয়টা নজরে রাখবেন বলে।

ধন্যবাদ জোনাকি। আমাদের সাহস তুমি একাই অনেক গুণ বাড়িয়ে দিলে। ধন্যবাদ মাহমুদা শেলী আপা, যে কিনা নিজে ঢাকার বাইরে একের পর এক এ জাতীয় ঘটনা একা একাই সামাল দেন। এবং আমাদেরকেও সাহস জুগিয়েছেন। বিশেষ ধন্যবাদ মারজিয়া প্রভাকে। ও বয়সে এট্টুখানি হলেও সমাজের এধরনের অসঙ্গতিগুলো ও খুব সাহসের সাথেই তুলে ধরতে শিখেছে। ওদের দেখে আমরা ভবিষ্যতকে দেখি। আর আমাদের সাথে আছে একপাল প্রজন্ম বন্ধু। সঙ্গীতা, সৈকত, রাসএল, অর্পি-তোমাদের উপস্থিতি, প্রতিটা আশ্বাস একেকটি কাজ সম্পাদনে অসীম সাহস জুগায়। 

আমরা আজ একটি মেয়েকে বাঁচিয়েছি, সব খবর আমরা পাবো না জানি, তারপরও আশা করবো, যখনই এমন প্রয়োজন হবে, আমরা একসাথেই লড়বো। বিশেষ করে মেয়েদের জীবন শুধুমাত্র সরকারি কিছু অপরিণামদর্শিতার হাতে ছেড়ে দিতে পারি না আমরা।

উইমেন চ্যাপ্টার সবসময়ই সোচ্চার থাকবে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.