ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী:
বাংলাদেশে এমন ছেলেদের সংখ্যা হয়তো খুবই কম আছে, যাদের শাশুড়ি জানে না তার আদরের জামাই কী খেতে পছন্দ করে…..! তার জামাই চটপটি পছন্দ করে, না ফালুদা, চিংড়ি মাছ, না রুপচাঁদা মাছ, ইলিশ ভাজা, না সরষে ইলিশ, খিচুরির সাথে ডিমের কারী পছন্দ, নাকি গরুর মাংস! গরুর কালি ভুনা পছন্দ, না মেজবানী, মুরগীর রেজালা পছন্দ, না রোস্ট, বিরিয়ানী কাচ্চি পছন্দ, না চিকেন, সকালে নাস্তায় পুডিং, না নুডুলস চাই, গুড়ের পায়েসে সে খুশি, নাকী ক্ষীর কিংবা ফিরনি…………….!!
বাংলাদেশের এমন মেয়েদের সংখ্যা হয়তো একেবারেই হাতে গোনা যাদের শাশুড়িরা জানেন যে, তাদের ছেলেকে দখল করে নেয়া পুত্রবধু কী খেতে পছন্দ করে! বাপের ঘরে নিজের সব প্রিয়জন, নিজের ছেলেবেলা, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছু ফেলে রেখে আসা ঐ অসহায় বধুটি মাছ খেতে ভালবাসে, না মাংস, রান্নায় বেশি ঝাল পছন্দ করে, না কম ঝাল, ভর্তা ভালবাসে, না সবজি, ডাল খেতে পছন্দ করে, না করে না, ঝোল রান্না পছন্দ, না ফ্রাই!! বাঙ্গালী খাবার পছন্দ, না চাইনিজ বা ম্যাক্সিকান, সে কম খেতে ভালবাসে, না একটু বেশি খেতে ভালবাসে, এ খবর এ সমাজে কেউ রাখে না।
তার ছেলেবেলাটার ভাঁজে ভাঁজে কিংবা মায়ের গয়নার বাক্সের মতো স্মৃতির বাক্সে চিরতরে বন্দিনী হয় তার সে সকল পছন্দ অপছন্দ আর শখের মুক্তোমালা!!
জামাই বাবাজী বাড়িতে এলে শ্বশুর মশাইয়ের বাজারের লিস্টটা বড় হয়। বড় মাছ, বড় মুরগী, সিনার মাংস, মিষ্টি, দই আর সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ জানিয়ে দেয় এ দেশে জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন কতোটা প্রকট। তার রাগ, তার অভিমান, তার হাঁচি, তার কাশি সবকিছু খুবই মূল্যবান। এমন শ্বশুর কম পাবেন যিনি জানেন না তার জামাতার কোন ব্র্যান্ডের শার্ট-প্যান্ট, লোশন, পারফিউম কিংবা হানিমুনের জন্য কোন দেশ পছন্দ!!
পক্ষান্তরে এমন শ্বশুর কম পাবেন, যে জানে তার ছেলে বউ শাড়ী পছন্দ করে, না ওয়েস্টার্ন, নীল পছন্দ করে, না কালো, গয়না ভালবাসে, না ভালবাসে না……..!!!
এমন শ্যালক শালিকা এদেশে সংখ্যালঘু, যারা জানে না তাদের ভালবাসার দুলাভাই কী খেতে, কোথায় বেড়াতে ভালবাসে, আর এমন ননদ দেবর এদেশে সংখ্যালঘু নয়, যাদের জীবনের একটা অন্যতম লক্ষ্যই থাকে ভাবীর জীবনযাপন ঘর সংসারে নিত্য ঘূর্ণিঝড় আনা…….!!!
লাভ-ক্ষতির হিসেব জানি না। শুধু ভাবতে ইচ্ছে হয়, এদেশের মেয়েগুলো নিজের বাড়ী, মায়ের আঁচল ছেড়ে আসার পর তাদের জীবনে আর একটা মা আসুক, যে জন্মদিনে পায়েস রেঁধে মেয়েটির মুখে তুলে দিবে, বেশী ঝালে মেয়েটির ঠোঁট জ্বলে বলে একটু কম ঝাল দিয়ে বলবে, আমারই ঝাল খেতে কষ্ট হয় তাই বুয়াকে বলেছি কম ঝাল দিতে, কিংবা মেয়েটি খেতে ভালবাসে, অথচ সকলের সামনে কম খেয়ে উঠে গেল বলে তার শুকনো মুখখানাতে লাবণ্য আনতে হাতে ফিরনির বাটিটা তুলে দিবে পরম মমতায়!
এটা কি খুব কঠিন কাজ ভুলে না যাওয়া যে, ছেলের বউটিও একটা মানুষ, কারো অতি আদরের সন্তান! তারও ইচ্ছা করে আপনার ফোনে মা ডাক শুনতে, আপনারই মেয়েদের মতো, আসামীর মতো বকাঝকা নয়!
তার ও ইচ্ছে করে হাড়ির মত মুখ করে কেবল তার আর তার ফেলে আসা পরিবারের দোষ ক্রটির সাতকাহন না শুনে একটু প্রশংসা শুনতে!
সবদিন না হোক, সপ্তাহের কোনো একদিন অন্তত তার পছন্দের খাবারকেই আপনাদের মেনু করুন। কেন ভুলে যান ,এই মেয়েটিই হোস্টেল থেকে ফেরার দিনে, তার বাবা হয়তো মাসের শেষে ধার করে হলেও বাজারের সব থেকে বড় মাছটি কিনে আনতেন, মা রাতের ঘুমকে আড়ি করে বানাতেন ক্ষীরের পাটিসাপটা বা নলেন গুড়ের পায়েস।।
আজ যে মলিন মুখে দিনরাত আপনাদের খুশির যোগান দিচ্ছে, কোনো একদিন এর মুখটা মলিন হলে মলিন হতো আরো কিছু মুখ, এর মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে তারা বাজি রাখতো তাদের নিজেদের সব শখ, আহ্লাদ আর সুখ!