আফসানা কিশোয়ার:
মানুষের অসুখে মৃত্যু হয়, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়-ভাগ্যবানদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। প্রচলিত ভাষায় বলতে গেলে “জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে” এগুলো জন্মের সময়ই মানুষের কপালে লিখিত হয়ে যায়।
আমার আজও মনে পড়ে স্কুলের বান্ধবীর আম্মু মারা গেছে, টানা হরতাল চলছে। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একজন বেবী ট্যাক্সিওয়ালার হাতে পায়ে ধরে গেলাম মিরপুর, দক্ষিণ বিশিল। সেখানে মৃতদেহ দাফনের সব কাজ চলছে, আমার বান্ধবী নিজে ডাক্তার, নির্বাক, শূন্য চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নামতেই আমার বুকে ওকে টেনে নিলাম, কাঁদতে দিলাম। নিজেও কাঁদলাম। সব কাজ শেষ হলে ফেরার পথে বেবী ট্যাক্সিতে একটা ইটের অর্ধেক এসে পড়লো, সামনের কাঁচ ভেঙ্গে গেল, আমি এবং ট্যাক্সি ড্রাইভার চলতেই থাকলাম। এসে পৌঁছলাম আবার অফিসে।
আমি আজও বিশ্বাস করি, মেনে চলি-পার্সোনাল টাচের বিষয়টা।
আপনি একবার ভেবে দেখুন, আপনার প্রিয়জন ইন্তেকাল করেছেন, আপনি সহজে খবর জানানোর জন্য হয়তো সোশ্যাল মিডিয়াতে খবরটি চাউর করেছেন, যাদের জন্য আসা সহজ তারা না এসে “RIP = rest is peace” লিখে ছেড়ে দিলেন-এ জিনিস গ্রহণযোগ্য নয়।
বিশ্বে যত মানুষ রোগে শোকে মারা যাচ্ছে, তার পঁচাশি ভাগ মানুষ তীব্র নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বও ভোগ করে মারা যাচ্ছে।
বন্ধুত্ব এমন এক সম্পর্ক, যা আপনার নিজের যোগ্যতায় অর্জন ও রক্ষা করতে হবে। কারণ মানুষ মা বাবা ভাই বোন এগুলো জন্মসূত্রেই লাভ করে।
আপনি ভীষণ ব্যস্ত,আপনার বিয়ে হয়ে গেছে,বাচ্চাদের জন্য সময় পান না, উইকএন্ডে নিজের কূল কি স্বামীর কূলের লোককে দাওয়াত করে খাওয়াতে হয় আমি সব জানি। তবু নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনার বন্ধু দরকার কি না!
ফেসবুকে ছবি, লাইক উপহারের চাইতে বন্ধুকে স্পর্শ করা অনেক জরুরি। নিজেকে ও বন্ধুকে সমান্তরালে বিশ্বাস করা জানতে হবে।
কাঁদার জন্য কাঁধ থাকতে হবে, যে বিনা প্রশ্নে ঐ কান্নাটা মেনে নিবে।
বন্ধু টাকা দেবে না, হয়তো চাইবে; বন্ধু খুব স্ট্যাটাসওয়ালা নাও হতে পারে, হয়তো আপনার প্রয়োজনে এক ব্যাগ রক্ত যোগাড় করে দিবে, বন্ধু আর কিছু না পারুক আপনার অহেতুক উগড়ে দেয়া বকবক শুনবে চুপচাপ।
ভার্চুয়াল জগতের বন্ধু ১০০০ জনের বিপরীতে যদি একজন রক্তমাংসের বন্ধু থাকে, তাহলেই আপনি ভাগ্যবান।
আসুন নিজ নিজ ভাগ্য পরীক্ষা করি।
RIP না লিখে চলেন জ্যাম ঠেলে বন্ধুর হঠাৎ চলে যাওয়া বাবা বা মা’র খাটিয়ে বইতে, কী সৎকার করতে।
আপনি যখন প্রথম লুকিয়ে সিনেমায় গিয়েছেন স্কুল কেটে মা বাবা বা ভাই বোন অথবা লাইফ পার্টনার অফিসের বস যায়নি-গিয়েছে বন্ধু। আপনার প্রথম লিখা প্রেমপত্রটা বন্ধুকেই শুনিয়েছেন আগে। আপনার অখাদ্য কবিতাটা বন্ধু কষ্ট হলেও শুনে বলেছে, দোস্ত ভালো হইছে।
আপনি একটা গোল্ডলিফ কিংবা এককাপ চা ভাগ করে বাসার কারো সাথে খান নাই, বন্ধুর সাথে খেয়েছেন। একসাথে জামাতে জলবিয়োগ করতে গিয়ে সদ্য কৈশোরে পড়া জননাঙ্গ দেখে এ-ওর গায়ে হেসে ঢলে পড়েছেন বন্ধুর সান্নিধ্যেই। প্রথম ছ্যাঁকা খেয়ে নিজের বাসা থেকে বিশ কিলোমিটার দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে কার বাসায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন মনে পড়ে? বন্ধুর বাসায়।
এখনো কি মনে হয় শুধু ফেসবুকে বন্ধুর বাচ্চাকে দেখা আর “মাশাল্লাহ বাবুটা অনেক কিউট” বলেই আপনার সেসব দিন উদযাপন সম্পন্ন হবে?
কী বলবেন-পুরানো বন্ধুদের অনেকের আনাগোনা আপনার বর্তমানের স্থিতিশীল জীবনকে টলায়মান করে ফেলবে? যে বন্ধু সবার সামনে আপনার অপরিণত বয়সের কর্মকে টেনে এনে আপনাকে বিব্রত করবে সে আসলে কোনকালেই আপনার বন্ধু ছিল না।
এ শহরের কোণে কোণে নির্বান্ধব মানুষ, তাদের নিজের হাত ছাড়া আর কোন হাত নেই আঁকড়ানোর, সেরকম হাত থাকলে আত্মহত্যার ভিডিও লাইভ হতো না, বরং আমরা যেমন করেছি তেমন হতো-যেখানে প্রাইভেট পড়ি গ্রুপে, তার সামনেই ছাপড়া দোকান, পড়া শুরুর আগে আড্ডা হয়, গিয়ে দেখি সেদিন আমাদের এক বন্ধু নাই; দোকানের মামা বললো, ও ঐদিকে গেছে, রিকশা গ্যারেজের দিকে। দৌড়ায়ে গিয়ে দেখি দুই পাতা ইনোকটিনের খালি স্ট্রিপ পড়ে আছে, নিচে শোয়া আমাদের বন্ধুও। আমরা কাউকে কোনো প্রশ্ন না করে নিকটবর্তী হাসপাতালে তাকে নিয়ে গেলাম বেবী ট্যাক্সিতে করে। স্টমাক ওয়াশ করে টরে তারপর তার বাসায় খবর দেয়া হলো।
আমাদের সেই বন্ধু এখন বউ বাচ্চা নিয়ে নিশ্চিন্তে আছে।
আমরা “মাই ক্লোজ ফ্রেন্ড হ্যাজ ট্যাইকেন স্লিপিং পিল, হোয়াট এ শিট” লিখে বন্ধুর ছবি দিয়ে সবাইকে ট্যাগ করি নাই। বরং তার দুঃখের কথা দিনের পর দিন শুনে তাকে হালকা করেছি, জীবনের পথে এনেছি।
বন্ধুকে জড়িয়ে ধরুন, আপনাকেও জড়িয়ে ধরতে দিন। বন্ধুত্বের লিঙ্গ বয়স স্ট্যাটাস সব ভুলে যান।
একজন মানুষকে তার বন্ধু ও শত্রু দিয়ে চেনা যায়।
আপনাকে কি চেনা যাচ্ছে?