মেয়েদের নিয়ে মন্তব্যে আমরা পুরুষরা সিদ্ধহস্ত

সজল মোহন:

সাবিলা নূরকে নিয়ে ফেসবুকে বেশ ঠাণ্ডা-গরম আবহাওয়া বইছে। অনেকেই তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। ওনার নাকি ১৩ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড এর একটি ভিডিও সম্প্রতি পাবলিশ করা হয়েছে ইউটিউবে। সেক্স স্ক্যান্ডাল। ইতিমধ্যেই বুঝে গেলাম তিনি একজন সেলেব্রেটি। সত্যি বলছি, আমি ওনাকে চিনি না। দ্বারস্থ হলাম গুগলের। সেখানেও দেখি একই কাহিনী! ভিডিও ভাইরাল হওয়ার খবর। শুধু উইকিপিডিয়ায় তাঁর বায়োডাটা দেখলাম। বেশ ট্যালেন্টেড মেয়ে। 

অনেক প্রগতিশীলও মনের মাধুরী মিশিয়ে বেশ রসালো স্ট্যাটাস দিয়েছে। আসলে প্রগতিশীলতা এদের মুখোশ মাত্র, অন্তরে তারা প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষ। ওঁৎ পেতে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। তাদের স্ট্যাটাস দেখেই বুঝেছি তারা ভিডিওটি দেখেছেন। মনে মনে অনেক কল্পনার জাল বুনেছেন। 

এক নজরে কমেন্টগুলা পড়ে দেখলাম। খুবই বাজে ও বিশ্রী মন্তব্য! আমি ভিডিওটি দেখিনি, দেখার ইচ্ছা আগ্রহ আমার নেই আর হবেও না। ভিডিওটি সত্যি সাবিলা নূরের কি না, তাও শিউর জানি না। আর যদি সত্যও হয়, তাতে কার বাপের কী! সেক্স করে না কে? সবাই করি। এটা প্রত্যেকের একান্তই ব্যক্তিগত।

সাবিলা নূরের ভালো লেগেছে, সাবিলা তার পছন্দের পুরুষের সাথে শুইছে। তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হইছে? কৃষ্ণও লীলা করেছে। নবী মুহাম্মদের কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধে। যাঁরা এখন সাবিলাকে গালি দেন, তাঁরাও তাদের বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড এর সাথে শুইছেন বা শোন।

দেখেছি প্রভার ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে। মাল, মাগী, বেশ্যা, নষ্টা মেয়ে বইলা গালি দিয়েছেন। চিরকালই সাবিলা-প্রভারা বেশ্যা, নটি, খানকি খেতাব পায়, রাজীবরা তা পায় না। রাজীবেরা মানে আমরা পুরুষেরা দুধে ধোয়া তুলশি পাতা! আরে বাপ সাবিলা নূর যদি তার পছন্দের পুরুষের সাথে শুইয়া বেশ্যা হয়, তাইলে ওই পুরুষটি সাবিলা নূরের সাথে শুইয়া কী লোকনাথ ব্রহ্মচারী হইছে? বা নবী হইছে?

এই তো সেদিন আমরা কয়েকজনে মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ এক বড় ভাই “লজ্জা” বইয়ের জন্য তসলিমা নাসরিনকে খানকি, মাগী কইয়া গালাগাল শুরু করছে! জিজ্ঞেস করলাম; ভাই তসলিমা নাসরিনকে আপনি কি বেশ্যাবৃত্তি করতে দেখেছেন? বললো, না!  তাইলে গালাগাল করেন ক্যান? 

আরে মিয়া তুমি “লজ্জা” বইটা পড়ে দ্যাখবা, তুমি নিজেই লজ্জা পাইবা! 

কেন কী লেখা আছে?

মাগী নিজের চাচার সাথে শুইছে, হেই কথা আবার লিখছে!

ভাই, আপনি তসলিমা নাসরিনের কয়টা বই পড়েছেন? 

ভদ্রলোক আর একটা বইয়ের নামও বলতে পারলেন না! এবার আর নিজে কন্ট্রোলে রাখতে পারলাম না। মুখে যা আসছে, তা-ই বললাম। তসলিমা নাসরিনের একটা বইও না পড়ে আপনি তসলিমাকে গালাগালি করেন। আপনি নিজে কতোটা সাধু! আপনার নিজের মুখের কথা আপনি অনেক মেয়েকে প্রতারণা করে, লোভে ফেলে ও জোর করে অনেক কিছু্ই করেছেন। এখন আপনার ঘরে বউ আছে, দুই সন্তানের বাবা হইছেন। এখনও আপনি প্রতি মাসে ৩-৪ বার পতিতালয়ে যান। আবার আপনি আইসা তসলিমা নাসরিনকে খানকি মাগী কইয়া গালাগাল দেন! পাড়ায় ৫০ জন পতিতা থাকলে, ৫০০ জন কাস্টমার আমরা পুরুষ। তারপরও আমরা পুরুষ পবিত্র, আর নারী অপবিত্র! সেই থেকে বেটা আমার সাথে কথা বলে না। 

আসলে গণ্ডগোলটা আমাদের গোড়ায়। আমাদের মানসিকতায়। নারীদের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণা আমরা ওয়ারিশ সূত্রে পেয়ে থাকি। ধর্ম ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাছ থেকে। ধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়; পুরুষ উৎকৃষ্ট আর নারী নিকৃষ্ট! নারীর অবস্থান কুকুর ও গাধার সমান! নারীকে কাবু করতেই আমরা পুরুষেরা কল্পিত সৃষ্টিকর্তা আবিষ্কার করেছি। ধর্মগ্রন্থ লিখে নারীকে বন্দী করেছি। নিজেদের সুবিধার্থে নারীকে দেবীরূপে হাজির করলাম, আবার দেবীকে বলা হলো পত্নী সেবাই নারীর পরম ধর্ম! পত্নীই নারীর ঈশ্বর!

অর্থাৎ নারী যতোই আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন মানুষ হোক, সব শেষে নারীর স্থান পুরুষের পায়ের নিচে! যুগে যুগে রবীন্দ্রনাথের মতো মহাপুরুষেরাও চেয়েছে নারী যেন ঘরের বাইরে না আসে। ঋষি, মুনি-ঋষি, নবী, আল্লাহ, ঈশ্বরের ও মহাপুরুষদের শকুনি দৃষ্টি এখনো নারীর ওপর।

পুরুষতন্ত্র ঠিক করে দিয়েছে সতীত্ব, বিয়ে আর মাতৃত্বই নারীর সব, নারী অহংকার, অলংকার! নারীরাও মনে করে তাই। নারীরা যতোদিন এরকম মনে করবে, ততোদিনই তারা হবে পুরুষের ভোগের বস্তু! ততোদিন প্রভা, হ্যাপি, সাবিলারা হবেন খানকি, মাগী, বেশ্যা আর আমরা পুরুষরা তাদের সাথে বাস্তবে অথবা কল্পনায় শুনয়ে হবো মহাপুরুষ, ঋষি, নবী। 

প্রভার সাহসরে আমি স্যালুট করি। প্রতিদিন যেই মানসিক নির্যাতন সহ্য করে প্রভা এখনো দাঁড়িয়ে আছে সোজা হইয়া, সেইজন্য প্রভারে অভিনন্দন। প্রভাই হতে পারে নারীদের দৃষ্টান্ত, নারীরা যেই অনুপ্রেরণা খুঁজে, সেটা প্রভার থেকে নিতে পারে। যেদিন নারী শিরদাঁড়াটা সোজা করে একবার ঘুরে দাঁড়াবে, বলবে কী কইলি তুই, পুরুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলবে, কলার ধরবে, প্রয়োজনে বীচি বরাবর লাথি মারবে, সেদিন পুরুষতন্ত্র ও পুরুষাধিপত্য ভেঙে টুকরো টুকরো হবে।

অধিকার কেউ কাউকে এমনি এমনি দেয় না, অধিকার আদায় করতে হয়। কী হবে প্রতিবাদ করলে? তোমাকে খারাপ মেয়ে বলবে? বলুক না। এখন যে তুমি প্রতিবাদ করো না, এখন কী তোমাকে ভালো মেয়ে বলে? তোমরা প্রতিবাদ করলেও খারাপ, আর প্রতিবাদ না করলেও তাই। জানোই তো তোমরা যে দেশে, যে সমাজে জন্ম নিয়েছো, সে সমাজে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করলেও কোনো সমস্যা নাই, যত্ত সমস্যা নারীর পোশাকে!!

নারী তাঁর প্রাপ্য সম্মানের জন্য, নারীরা অসম্মান বা ইভটিজিং থেকে নিজেকে বাঁচাতে এবং নিজেদের আত্মমর্যাদাবোধটুকু রক্ষা করতে দরকার নারীর গণজাগরণ। নারী জাতির স্বাধীনতা ও সম অধিকার নিশ্চিত করতে, দরকার নারী আন্দোলন। অপু বিশ্বাস একজন শিক্ষিতা, সচেতন, মোদ্দা কথা, পরনির্ভরশীল ছিলেন না। তবুও অপু বিশ্বাসকে নিজের ও সন্তানের স্বীকৃতি ও অধিকারের জন্য মিডিয়ার সামনে এসে কাঁদতে হয়েছে।

এবার ভাবুন গ্রামের বা বস্তির একজন অশিক্ষিত, অসচেতন ও পরনির্ভরশীল মেয়ের কী অবস্থা! সুতরাং নারী জাতির অস্তিত্বের লড়াইটা নারীদেরই করতে হবে। নারী মুক্তির সূচনা হোক আপনার হাত ধরেই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.