আসুন, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করি

লীনা ফেরদৌস:
বাঙালী মেতেছিল তার প্রাণের উৎসবে, সার্বজনীন উৎসবে। পুরনো সকল দুঃখ-গ্লানি-বাধা সব মুছে দিয়ে নতুন আশায় নতুন করে জীবন সাজিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় আসে পহেলা বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম দিন- বাংলা নববর্ষ। কিন্তু পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে আজকাল অনেকে অনেক রকম ধর্মীয় তকমা লাগিয়ে সবার মনে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। এই প্রাণের উৎসবটিই আজকাল পালন করতে হয় ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে।
আসলে আমাদের সবার একটা ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত যে, ধর্ম আর সংস্কৃতি এক নয়। একটি দেশে অনেক ধর্মাবলম্বী মানুষ থাকতে পারে, কিন্তু জাতিগত কারণে তাদের একটি সংস্কৃতি আছে, যেটা কিনা সার্বজনীন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো, তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হতো। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো।
খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যেই মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে।
প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো, এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো।
এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়ে থাকে।প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব। ধর্ম, বর্ণ সব ভেদাভেদ ভুলে সবাই একসাথে নতুন সূর্যকে বরণ করে, নতুন আশায় নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখি ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় শহর থেকে শুরু করে প্রতিটি গ্রামে গ্রামে পালিত হয় বর্ষবরণ। চারিদিকে বৈশাখ মেলার ধুম পড়ে। বাংলার মানুষের হাজার বছরে ঐতিহ্যবাহী উৎসব বাঙ্গালীর সার্বজনীন উৎসব- পহেলা বৈশাখ, কোন বিশেষ ধর্মের উৎসব এটা নয় ।
ইতিহাস বলে দেয় মুঘল আমলেই এই উৎসবের শুরু। এই উৎসব সে দেশের কৃষ্টি, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে লালন করে। তাই আমাদের উচিত কোন ভুল তথ্যতে বিভ্রান্ত না হয়ে নিজের শেকড়ের সন্ধান করি এবং সঠিক ইতিহাস জেনে নিয়ে নিজেদের শিকড়কে অবিকৃত রাখি এবং জাতী হিসাবে আমাদের কৃষ্টি আর ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরি।
আসুন তাই সবাই মিলে বছরের শুরুতে একসাথে প্রার্থনা করি যে বৎসরের আবর্জনার সাথে সাথে আমরা যেন আমাদের মনের আবর্জনাও দূর করতে পারি এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের কালো ছায়া থেকে আমাদের কৃষ্টি আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পারি।
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.