তামান্না ইসলাম:
উইমেন চ্যাপটারে ‘চল্লিশের বন্ধুরা ভালো থেকো’ নামে একটি আর্টিকেলে চোখ আটকে গেল সেদিন। খুব আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। তথ্যবহুল আর্টিকেল নিঃসন্দেহে। তবে একটি ব্যাপারে মনটা খুঁত খুঁত করছিল। সেটা হলো লেখার টোন, কেমন যেন একটা করুণ সুর, মনে হচ্ছিল চল্লিশ হলেই স্বামীদের মাথা আউলা হয়ে যাওয়ার কিছু যুক্তিযুক্ত মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে, আর স্ত্রীদেরকে তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ আমরা তারও আগে বুড়িয়েছি, অর্থাৎ মানসিকভাবে আমরাই হবো পরিপক্ব, আর তারা হয়ে যেতে পারে একটু শিশুসুলভ, তাই তাদের সেইসব আউলা মনের বাউলা খেয়ালকে বিবেচনার সাথে ম্যানেজ করতে হবে।

হঠাৎ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একদিন যখন দেখা যায় কপালের দুপাশে কিছু অবাধ্য রুপোলী ঝিলিক, টান টান সিঁথির আশে পাশে তার চেয়েও বেয়াড়া খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু শুভ্র অতন্দ্র প্রহরী, চোখের পাশে কুঁচকানো চামড়া, কমে গেছে হাত, পায়ের ত্বকের মসৃণতা, গলায় ভাঁজ, কোমরের পাশে জমে থাকা বাড়তি মেদ, আরও হাজারটা পরিবর্তন তখন কিন্তু নিজের সম্পর্কে চির উদাসীন মেয়েটার মনেও একটু হলেও বিষণ্ণতা জাগে। ফুরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টা ধ্বনি বাজে নিজের অজান্তেই কোথাও। সেটা এজন্য নয় যে তার আকর্ষণ বা চাহিদা কমে যাবে অন্যের কাছে বরং নিজের সৌন্দর্য, স্বাস্থ্য ফুরিয়ে যাচ্ছে, দিন ঘনিয়ে আসছে সেই দুশ্চিন্তায়। হাজার হলেও মানুষ মাত্রই নিজেকে সুস্থ, তরতাজা, সুন্দর দেখতে চায়। এটাই স্বাভাবিক।
রূপ লাবণ্যের চেয়েও যেই ক্ষয়টা অপূরণীয় সেটা হল স্বাস্থ্য।
চল্লিশের পরে এসে শরীরের মেটাবোলিজম কমে যায় বলে মেদ কমানো খুব কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে এবং আরও অনেক কিছুর সমন্বয়ে বিভিন্ন ধরনের রোগের উপসর্গ শুরু হয়। রক্তে বাড়তে থাকে চিনি, অর্থাৎ ডায়াবেটিস, বাড়তে থাকে কলেস্টোরল, রক্ত চাপ। ঘুম কমতে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের আরথারাইটিস বা জয়েন্টের পেইন দেখা দেয়। পিরিয়ডের অনিয়ম, জরায়ুর সমস্যা এগুলোও দেখা দেয়।
বাড়ে চোখের পাওয়ার, এজন্যই তো চোখের এক অসুখের নামই আছে চালশে। মেয়েদেরকে অনেক বেশি কষ্ট পেতে দেখেছি মেনোপজ, তার আগের উপসর্গ এবং ডিপ্রেশন নিয়ে। প্রচণ্ড মুড সুইং, ‘নিজের জীবনে কিছুই হলো না’ , ‘সারা জীবন শুধু সংসারের সবার জন্য করেই গেলাম, আমি কী পেলাম?’, ‘আমার জন্য কেউ নাই’, ইত্যাদি সব নেগেটিভ চিন্তা, জীবনের সব কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এসব কিছু মিলিয়ে এক প্রচণ্ড অবসাদ এসে ঘিরে ধরা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
হরমোনের পরিবর্তন এর জন্য অনেকটা দায়ী। সেই সাথে শারীরিক শক্তিও কমে আসে, কমে আসে স্মৃতি শক্তি। এই হঠাৎ পরিবর্তনগুলো আত্মবিশ্বাস অনেক খানি কমিয়ে দেয়। রাতের ঘুম কমে যাওয়া, হট বা কোল্ড ফ্লাশ এগুলো নিয়েও অনেকে বেশ অস্থির থাকে।
অনেকেই এই বয়সে এসে আবিষ্কার করে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে, তাদের নিজের জগত হয়ে গেছে, মা ছাড়া যেই বাচ্চাটা আগে কিছুই বুঝতো না, সে এখন একজন পরিপূর্ণ স্বাবলম্বী মানুষ। দীর্ঘদিনের দাম্পত্যেও মাঝে মাঝে আসে এক ঘেয়েমি। আবার কারো কারো বাচ্চারও বয়ো:সন্ধি অর্থাৎ সেই হরমোনের পরিবর্তন চলে একই সাথে।
কারো কারো ক্ষেত্রে মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুড়ি, মরণাপন্ন বা শয্যাশায়ী থাকে, তাদের সেবা যত্নের জন্য দরকার হয় অফুরন্ত শক্তি এবং ধৈর্য। অথচ শারীরিক, মানসিক শক্তি আর ধৈর্য্য সবই তখন ভাটার দিকে। নিজের অক্ষমতায় নিজের মনেও তৈরি হয় হতাশা। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, কথা শোনানো যাচ্ছে না, অথচ দুশ্চিন্তা তো থেমে থাকছে না, এই পরিবর্তনটা চট করে মেনে নেওয়াও কঠিন।
দাম্পত্য সম্পর্কেও নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশের সাথে সাথে বাড়তে পারে ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ। চুপচাপ নিরীহ মেয়েটি যখন মুখ ফুটে মতামত দিতে শুরু করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করে তখন ক্ষমতায় অভ্যস্ত স্বামী সেটা মেনে নিতে নাও পারে। আর তাই এ বয়সে এসে বিয়ের দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করে ঘর ভাঙতেও দেখা যায় অনেক।
সব কিছু মিলিয়ে চল্লিশ পরবর্তী জীবনে ব্যাল্যান্স রাখা, স্বাভাবিক গতিতে জীবনকে চলতে দেওয়া কঠিন কাজ, পরের লেখায় আসছি কিছু টুকটাক টিপস নিয়ে চল্লিশ পরবর্তী বান্ধবীদের জন্য। ততদিন পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন বয়সকে হারিয়ে দিয়ে।