বাকী বিল্লাহ:
‘হিন্দুয়ানী’ শব্দটা একসময় শুধু দৈনিক ইনকিলাবের পাতায় দেখা যেত। কিন্তু গত কয়েক বছরে শব্দটার রমরমা প্রসার ঘটেছে। মুসলিম তমুদ্দনের পক্ষের বিদগ্ধ তাত্ত্বিক থেকে শুরু করে সদ্য গজানো ফেসবুক ইন্টেলেকচুয়ালগণও শব্দটার যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করেন। তাদের ব্যাখ্যায়- হিন্দুয়ানী হচ্ছে এমন কিছু যা বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক প্রতিপক্ষ।
তাদের দাবি, বাঙালি সংস্কৃতির নামে মুসলমানের উপর হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া যাবে না। বাঙলা নববর্ষও তাদের বিচারে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। এটা বলার সময় তারা ফেরত যান ওহাবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানের ধর্ম চর্চার ভেতর থেকে হিন্দুয়ানী উপাদান দূর করা ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম চরিত্র।
হাজী শরীয়তউল্লাহ দীর্ঘদিন মক্কায় থেকে পরে দেশে আসেন। মক্কায় তার দেখা ইসলামের সাথে বাঙালির ইসলাম চর্চার অমিল দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন, অস্বস্তিতে পড়েন। এখানে ইসলামের সাথে লোকায়ত নানান উপকরণ মিশে ছিল, কারণ এই লোকাচারগুলো এখানকার মানুষের দীর্ঘকালের জীবন-যাপনের অংশ।
হাজী সাহেব মক্কায় ইসলামের আদলে যা যা দেখেছেন সেগুলোও কিন্তু ওখানকার মানুষের হাজার বছরের লোকাচারের ঐতিহ্য। ইসলাম যদি আরবের মানুষের লোকাচার বদলে না দেয় তাহলে বাঙালির লোকাচার বদলে দিতে হবে কেন? আরবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা অধিকাংশ মুসলমানের এই ভেদবিচারের জ্ঞান থাকে না, হাজী শরীয়তউল্লাহরও ছিল না।
ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবে বাঙলার ইসলাম অনেক বদলে যায়, কিন্তু নিজস্ব লোকাচার থেকে মানুষ কতটুকু আর বিচ্ছিন্ন হতে পারে। বাঙালি মুসলমানের মেয়ের বিয়েতেও তাই গায়ে হলুদ হয়, ধান-দূর্বার আশীর্বাদ দেয়। মুসলমান নারী শাড়ি পরে। গোল হয়ে বসে সুরে সুরে মিলাদ পড়ে বাঙালি মুসলমান-পৃথিবীর আর কোনো জায়গার মুসলমান সেটা করে না। শত শত বছর ধরে সালাফী-ওহাবীরা এগুলোকে হিন্দুয়ানী বলে বাদ করে দিতে চেয়েছে, বাঙালি মুসলমান সেগুলো বাদ দিতে পারেনি।
কারণ ব্যাপারটা হিন্দুয়া্নী বা মুসলমানিত্বের নয়, লোকায়ত সংস্কৃতির পরম্পরা। বাঙালির ভাষা বদলে দিতে চেয়েছিল তারা, যুক্তি ওই একই। বাঙলা নাকি হিন্দুয়ানি ভাষা। এইটাও শত শত বছর প্রচারণার অংশ। মধ্যযুগে কবি আব্দুল হাকিমকে বলতে হয়েছিল- যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহারও জন্ম নির্ণয় ন জানি।
বাঙলা নববর্ষের উৎসবকে হিন্দুয়ানী বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার যে রাজনীতি তা অনেক পুরোনো। এগুলোর সাথে লড়াই করেই বাঙালি তার সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে। তাতে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কারোরই ধর্ম নষ্ট হয়নি। তাই আজ যারা বাঙালির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মক হবে তাদেরকে আব্দুল হাকিমের ভাষাতেই জবাব দিতে হবে।