শান্তা মারিয়া:
পুরো দেশটাই মনে হয় অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মন্ধতা আজ রাহু হয়ে গ্রাস করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। পহেলা বৈশাখের মতো আমাদের প্রাণের উৎসবকেও গ্রাস করতে চাচ্ছে এই রাহ
বৈশাখের বর্ষবরণ আমাদের জাতীয় উৎসব। এই একটি মাত্র উৎসবে পুরো দেশ একসঙ্গে মিলতে পারে। আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের, আদিবাসীদের নানা রকম উৎসব রয়েছে। কিন্তু পহেলা বৈশাখের উৎসবটি সার্বজনীন। এখানে সব ধর্ম সম্প্রদায়, সকল আদিবাসী গোষ্ঠি, পাহাড় ও সমতল, সকল বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, নারী পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ একসঙ্গে মিলে আনন্দ করতে পারে।
ভাবতে অবাক লাগে এমন একটি উৎসবেরও বিরোধিতা হয়! ২০০১ সালে পহেলা বৈশাখের উৎসবে চরম ঘৃণ্য বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১০ জন দর্শক। আহত হয়েছিলেন আরও অনেকে।
২০১৫ সালে পহেলা বৈশাখের উৎসবে নারীদের উপর ভয়াবহ যৌন আক্রমণ চালানো হয়। সেই উৎসবে প্রকাশ্যে ভিড়ের মধ্যে শত শত নারীর উপর হামলা চালানো হয়। সেই আক্রমণ থেকে নারীদের বাঁচাতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা লিটন নন্দীসহ অনেক কর্মী আহত হন। অথচ সেই ভয়ংকর ঘটনার এখনও পর্যন্ত বিচার হয়নি। মাত্র একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যা আই ওয়াশ ছাড়া কিছুই নয়।
এ বছর আবার বিরোধিতা হচ্ছে পহেলা বৈশাখের উৎসবের আকর্ষণীয় অংশ মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা তুলে ধরে আবহমান বাঙালির প্রিয় প্রতীকগুলোকে। ল²ী প্যাঁচা, মাটির টেপা পুতুল, বাঘ, হাতি, ঘোড়া, পাখি, কুলা, ডালা, মঙ্গলঘট, সরা, কলসী ইত্যাদি প্রতীক যা এদেশের চিরন্তন লোকজ ঐতিহ্যের ধারক সেগুলোই থাকে মঙ্গল শোভাযাত্রায়। ধর্মের দোহাই দিয়ে কেন এর বিরোধিতা? মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে তো কোনো ধর্মেরই কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক রয়েছে সুপ্রাচীন বাঙালির লোকজ ঐতিহ্যের সঙ্গে।
পহেলা বৈশাখের উৎসব নিয়ে আমি অন্য একটি সাইটে একটি লেখা দেই। তাদের ফেসবুক পেজে সে লেখাটির নিচে অসংখ্য কমেন্ট দেখে অবাক হয়ে যাই। অধিকাংশ কমেন্টে গালাগাল করা হয়েছে। আমাকে তো বটেই, সেইসঙ্গে পহেলা বৈশাখকেও। আমাদের সমাজটা যে ভিতরে ভিতরে কত ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছে তা ওই কমেন্টগুলোতেই প্রমাণ করা যায়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সম্পূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ধীরে ধীরে আবার স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি ঘাঁটি গাড়ে। মাদ্রাসা ও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (ইংলিশ ও বাংলা দু’রকম মিডিয়ামের মধ্যেই এ ধরনের লুকানো সাম্প্রদায়িক শিক্ষা দেওয়ার প্রতিষ্ঠান আছে) সাম্প্রদায়িক ও অন্য ধর্ম বিদ্বেষী শিক্ষা দেওয়া হয়। বলা যায় একটি প্রজন্মের মগজ ধোলাই করে ফেলা হয়। এই মগজ ধোলাই এখনও চলছে। এদেশের মানুষের ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর ধান্দাবাজ মানুষ সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। আবার এরাই কিন্তু নারীর সকল অধিকারকে মুঠোয় পুরে নারীকে পশ্চাৎপদ করেও রাখতে চাচ্ছে।
পরবর্তিকালেও ভোট ও ক্ষমতার রাজনীতির ধারক বাহকরা সাম্প্রদায়িকতাকে, ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেয় নিজেদের স্বার্থে। একটা কথা মনে রাখতে হবে ধর্মীয় মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং নারীর অধিকারের বিরুদ্ধতা-এই সব রসুনের গোড়া কিন্তু এক জায়গায়। একটিকে প্রতিরোধ করতে চাইলে অন্যটিকেও প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ তারা পরষ্পরকে শক্তি জোগায়।
পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। ‘জীর্ণ পুরাতন’কে অশুভকে, অমঙ্গলকে দূরীভূত করে নতুন দিনের নতুন আলোয় চোখ মেলবার দিবস।
পহেলা বৈশাখকে সফল করতে এবং সকল বিরোধিতার মূল উৎপাটন করতে আসুন দলে দলে পথে নামি। পহেলা বৈশাখের দিন আমরা নারীরা সাজসজ্জা করে আসুন সকলে দলবেঁধে উৎসবে অংশ নেই। আমাদের সম্মিলিত শক্তির কাছে অশুভ শক্তি পরাজিত হতে বাধ্য।
আসুন বৈশাখী ঝড় হয়ে উঠি আমরা। বৈশাখী ঝড়ের শক্তি দিয়ে সকল নারী নির্যাতনকারী, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারকারী, জাতীয় বিভেদ সৃষ্টিকারী সকল আবর্জনাকে উড়িয়ে দেই। ঝেঁটিয়ে বিদেয় করি সকল মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ ও নারী নির্যাতনকারী অপশক্তিকে।
‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’
আমাদের সম্মিলিত শক্তির বৈশাখী ঝড় উড়িয়ে নিক, দূর করে দিক সকল অপশক্তিকে। ১৪২৪ বঙ্গাব্দ হোক শুভ, সুন্দর, কল্যাণে উদ্ভাসিত। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সকলের শুভ হোক, মঙ্গল হোক। শুভ নববর্ষ।