ক্যারিয়ার গঠনের আগে বিয়ে নয়

নোরা হাবীব: 

গোটা জীবন চষে শুধু একজন মানুষই পেয়েছি যে কীনা যে কোন তন্ত্রের ঊর্ধ্বে, শুধুই মানুষ বাদের পক্ষে। তিনি আমার বাবা।  তাছাড়া বাদবাকি সবাইকে পেয়েছি সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে দিনশেষে পুরুষতান্ত্রিকতারই পূজারি।  এমনকি খানিকটা আমিও। কারণ যোগ্যতা থাকা সত্বেও একজন পুরুষ এর উপর নিজের ভরণপোষন এর দায়িত্ব অর্পণ করে বসে আছি। একটি সামান্যতম ইচ্ছা পূরণ করবার জন্যও নির্ভর করতে হচ্ছে পুরুষের ইচ্ছার উপর। 

অথচ বাবার বাড়ি থাকতে এমন কিছু মনের ভেতর উঁকিও দেয়নি। বুঝতামই না কী এই পুরুষবাদ, কীইবা এই নারীবাদ। কারণ বাবা আমার কাছে পৃথিবীর সকল মানুষের ঊর্ধ্বে, সবার থেকে আলাদা। তাকে পুরুষের কাতারে ফেলি কী করে? বরং মা’ও যদি কখনো কখনো কোন কোন বিষয়ে নারীকে শেকলে বাঁধতে চেয়েছেন, বাবা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে মানুষ হিসেবেই আমাদের তৈরি  করতে চেয়েছেন, ঘোমটা পরা, নাকে নথ দেয়া মেয়ে মানুষ হিসেবে না। 

কিন্তু আমার পিতার নাম দাঙ্গাল সিনেমাওয়ালা আমীর খানের মতো সমাদৃত হবে না সবার কাছে। আমার পিতার মুখ গৌরবের আনন্দে উদ্ভাসিত হবে না সূর্যালোকে। কারণ আমি এখন শুধুই একজন গৃহবধূ। আর এই আমার এবেলার একমাত্র পরিচয়। 

এ আমি তো শুধু আমি নই। এ বাংলার হাজারো মেয়ের প্রতিচ্ছবি আমি। যোগত্যা থাকা সত্যেও ক্যারিয়ার শুরু করতে পারিনি, পারিনা এখন। কারন ক্যারিয়ার শুরু করতে গেলে সংসারের বয়জৈষ্ঠ সদস্যদের তুলনায় উপার্জন নেহাত নগণ্য হবে আমার। এ ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারলেও আমার বিবাহিত জীবন কি পারবে মেনে নিতে?

আমি তো চেয়েছিলাম পি এইচ ডি করতে, আমি তো চেয়েছিলাম গবেষক হতে, আমি তো চেয়েছিলাম বক্তা হতে। হ্যাঁ  এমনই তো স্বপ্ন দেখিয়েছিল বাবা। তবে আজ কেন আমি ক্যারিয়ার বলতে শুধুই অর্থ উপার্জনের একটা পথ বলে ভাবছি? এ কেমন গোলকধাঁধা!!

কারণ আমার বিতার্কিক হয়ে ওঠাটা একমাত্র বাবাই মেনে নিতে পারতেন। আমার বর্তমান বলয়ের কেউই তা মেনে নিতে পারবে না। সবাই ধর্মের ঢাক নিয়ে আসবে…..পতি ধর্ম নিয়ে আসবে.. সংসার ধর্ম নিয়ে আসবে। এমনকি আমার মাও কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলবে, সংসারটা শান্তিতে ধরে রাখ ‘মা’। আর আমিই বা বেচেঁ থাকার জন্য আশ্রয় পাবো কোথায়। বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকবো? লোকে কী বলবে? বাবা-মা সমাজের কাছে ছোট হয়ে থাকবে, এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবো তো?

তাই আজ বাবাকে সবচেয়ে দোষী মনে হয়। কী দরকার ছিল বাবা আমাকে মানুষ বানিয়ে? তার চেয়ে মেয়েই না হয় বানাতে! তাহলে আর এভাবে অন্তর জ্বালায় ভুগতে হতো না এই দু’ আনার জীবনে। আর বানালেই যখন, কী হতো আর দু’ চার বছর পর বিবাহ নামক জালের ভেতর ছুঁড়ে দিতে। 

আমি তো তরতর করে উঠছিলাম। তীব্র স্পৃহা নিয়ে সূর্যের দিকে হাঁটছিলাম…কেন এ কুসংস্কার এর সমাজে ঠেলে দিলে? 
হয়তো আরেকটু বেশি বয়স হলে ভালো বেতনের স্বামী জুটতো না ঠিকই। কিন্তু নিজেই হয়তো নিজেকে ভালো একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে পারতাম।

আমার স্বামীজী ভদ্র, সুশীল অনেক পরিশ্রমী একজন মানুষ। বউকে ভালোও বাসে খুব। কিন্তু শুধু সেই রবী ঠাকুরের অপুকে কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কোনো ভাবেই না। আর আমি যেন সাক্ষাত সেই হৈমন্তী …  পরিণতিও সেরকমই হবে ভাবছি। এ সমাজে এখনো অজস্র অপু রয়েছে, অজস্র হৈমন্তী প্রতিনিয়ত অস্তাচলে তলিয়ে যাচ্ছে।

তাই আজ প্রিয় বোনদেরকে বলছি, প্রেমের জালে হোক আর পরিবারেই চাপেই হোক ট্রেনে না উঠে স্টেশন ছেড়ে চলে যেও না প্লিজ। নিজেকে আগে নিজের রাস্তার দিকে ধাবিত করো, তারপর বিবাহিতার খাতায় নাম ওঠাও। নতুবা সারাজীবন পুরুষতান্ত্রিকতার জাঁতাকলেই পিষ্ট হতে হবে। একটি ভিক্ষুককে ১০ টাকা দান করতে চাইলেও স্বামীর কাছে হাত পাততে হবে নতুবা সন্তানের কাছে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.