ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী:
আমার স্পষ্ট মনে আছে আজ থেকে এক যুগ আগেও মেডিকেল ছাত্রী থাকাকালীন আমার কোন মোবাইল ছিল না। প্রায় দুই শত ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে কেবল অল্প সংখ্যক ছিল যারা মোবাইল ব্যবহার করতো!

আমাদের মেডিকেল জীবনে ও শহরে এত রেষ্টুরেন্ট ছিল না, এতো প্রোগ্রাম, পার্টি, হৈ চৈ, এতো এতো সেলফি, এতো এতো ফটোসেশন কিছুই ছিল না। তাই বলে জীবন বসে থাকেনি।
গত কয়েক বছরের মধ্যে তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উৎকর্ষের সাথে সাথে আনন্দ বিনোদনের হাজারো উপকরণ এখন আমাদের মুঠির মধ্যে। মুহূর্তে সমগ্র পৃথিবীটা ড্রইং রুমে আর ড্রইং রুমের বড় ঝুল পর্দাটা সরাতেই বেড রুমে!
এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য আমরা সকলে প্রস্তুত তো?
আমি বিশেষত নারীদেরকেই বলছি। আমরা কি প্রস্তুত? এখনও অনেক মধ্যবয়সী মা রয়েছেন যারা এই উর্ধ্বগতির সাথে তাল মেলাতে পারছেন না। কিশোরী মেয়েটির হাতে দামী ল্যাপটপ আছে। সে তার বেডরুমে আছে। মা নিশ্চিন্ত। কিন্তু নিশ্চিন্ততার প্রহর যে কেটেছে তার, বোঝারই সাধ্য নেই।
আমার ছোট বোন যখন প্রাইমারী থেকে গার্লস স্কুলে প্রচণ্ড কঠিন ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিল, আমার বাবা বলেছেন, ফার্স্ট হতে পারলে তোমাকে স্বর্ণের চেইন দিব। আমার বাবাকে চেইন দিতে হয়েছিল। এ বছর শুনলাম সেই ভর্তি পরীক্ষায় শুধু চান্স পাবার পর বাবা ট্যাব কিনে দিয়েছে! এক তৃতীয় শ্রেণীর বাচ্চা সাফল্যে যদি ট্যাব পায়, তাকে আর পড়বার সুযোগ তো আমিই কেড়ে নিচ্ছি।
আমি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করবার সময় এক মেয়েকে দেখেছিলাম। ওর তথাকথিত প্রেম, ঝগড়া, প্রেমিকের প্রতিশোধ কিছুই বাড়ীর লোক জানে না। মেয়ে স্কুলে যায়। এসব এক আধটু হতেই পারে। তাদের মাথায় বজ্রাঘাত হলো যেদিন বাড়ীরই কেউ দেখে এলো ঐ মেয়ের ভিডিও নেট থেকে। ঝগড়ার পরে সরি লিখে মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে বন্ধুরা মিলে তাকে রেপ করে এবং ভিডিওটি লিক করে।
আগের যুগে চারটা বাচ্চা একসাথে হলে হৈ চৈ এ কান পাতা দায় হতো। এখন চলে আসে কবরের নিস্তব্ধতা। ছোট ছোট শিশু নেশাখোরের মতো ডুবে আছে গেম বা রাইমে!
বরাবরের মতো যাদের নিয়ে ভয়টা সব থেকে বেশী তারা নারী। আমি বলতে কষ্ট বোধ করলেও এই সমাজে এখনও নারীরাই সব অপ্রীতিকর ঘটনার প্রথম শিকার। নারী মায়ের জাতি,নারী সম্মানিত হলেও প্রকৃতির তৈরি নারীর শত ভাঁজের শারীরিক গঠন তো বদলে যায়নি! বদলে যায়নি কিছু লোভী কামুক পুরুষের লিপ্সা। বরং অনেক বেশি সুযোগ তাদের হস্ত মুঠিতে!
তাই তুমি মা, বোন, মেয়ে যেই হও, আমি তোমাকেই বলছি। তোমার হাতে আই ফোন। পার্সে ট্যাব। টেবিলে ল্যাপটপ! তোমার স্ক্রিন জুড়ে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটস আপ, ইমো, ভাইবার, স্কাইপ, আরো কত কী!
একটু হাই! হ্যালো!
ফেসবুকের কমেন্ট পর্যন্ত ঠিকই ছিল। দেন এলো ম্যাসেঞ্জারে! আজ এক কথা। কাল দুই কথা। কবিতার কলি। গান মালা।শেয়ারিং। তোমার জন্য ফেলা টোপ তুমি ধীরে ধীরে গিলছো। এ এক বড়শী বড়শী খেলা চতুর খেলোয়ারদের।
তুমি টিন এজ। মা বকলো, বাবা বকলো, কিংবা বাবা-মায়ের ঝগড়া – কষ্টটা শেয়ার করছো কোন আধ বুড়ো জিনিয়াসকে। সে তোমার সব শুনছে। সান্ত্বনা দিচ্ছে। তুমি খুঁজে নিচ্ছো আশ্রয়। আবেগ তাড়িত হচ্ছো। এক সময় তুমি শব্দের কথামালা থেকে ছবিতে এলে। ছবি রেখে ভিডিও। দেন একদিন জীবন্ত ভেসে উঠলে স্ক্রিন জুড়ে। আবেগ বাড়লো। নির্ভরতা বাড়লো।তুমি বিশ্বাস করলে তাকে। ইথারের তরঙ্গ বেয়ে তোমার একান্ত গোপন কিছু গোপনে সংগ্রহ হলো তার কাছে।
পরবর্তীতে তুমি শুধুই নরকে জ্বলবে। তোমারই পাঠানো ভিডিও তোমাকে বাধ্য করবে তার সাথে বিছানায় যেতে। হয়তো কোনো গোপন ক্যামেরায় এটাও সংরক্ষিত হবে। এর পরের ধাপ হয়তো তুমি তার অঙুলি ইশারার একটা পুতুল মাত্র।অভিমানী, আহ্লাদী, জেদী পুতুল তুমি? মাত্র কয়েকদিনেই হয়ে গেলে কারো নষ্ট খেলার পুতুল।
তুমি চাকরিজীবী? বিবাহিতা? ডিভোর্সড? অবিবাহিতা? একা থাকো? স্বামী বিদেশে? স্বামী ব্যস্ত? বাচ্চা নেই? তোমার সাথে আলাপ জমানো আরো সহজ। একটু সময় নিয়ে তোমার দুর্বলতাটা জানা। জন্মদিনে মন খারাপ। একটু ছোট্ট চমক। তারপর গল্প। শেয়ারিং। এক সময়ে প্রেম নিবেদন। নিজেকে অসুখী আর তোমার বাহুডোরে সব সুখের ঠিকানা বলে তোমাকে বিলিভ দেয়া।
তুমি জানতেই পারছো না খুব রাশভারী তুমি – কলেজের শিক্ষিকা, ব্যাংক ম্যানেজার, পুলিশ কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা বা ডাক্তার সবকিছু ভুলে গিয়ে আর্ট ফিল্মের চরিত্র হতে চলে গেছো নির্জনে। লোকালয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবার মুখ আর তোমার থাকবে না।
নারী, তুমি মনে রেখো, তুমি পণ্য না। অন্য কেউ একা তোমাকে পণ্য বানাতে পারবে না, যতোক্ষণ না তুমি নিজে তোমাকে ভুল জায়গায় প্রেরণ করবে। নারী স্বাধীনতা বা নারী জাগরণ মানে প্রকৃতি বিরোধিতা না। তোমার শরীর বিধাতা প্রদত্ত উপহার। তোমার শরীর মন তুমি অপাত্রে সমর্পন করো না। তোমার পারিবারিক, ধর্মীয় এবং একাডেমিক শিক্ষা যেন তোমার চারিদিকে এক স্বর্ণোজ্জ্বল বর্ম তৈরি করে দেয়, যা তোমাকে সৎ এবং সুন্দর জীবন-যাপনে সাহসী করবে, কারো পদতলে মাথা নত করতে বাধ্য করবে না।
নারী তুমি অপার শক্তির আধার। নারীর লোভ আর ভোগ বিলাসই পুরুষের অস্ত্র। যদি সব নারী সম্মান, সম্ভ্রমের জন্য ত্যাগ স্বীকারে ব্রতী হতো, তাহলে সমাজে মন্দ পুরুষগণ আত্মাহূতি দিতে বাধ্য হতো! কেবল মহাপুরুষগণই বেঁচে থাকতো।
তাই বর্তমান পৃথিবীতে নারী তোমার জাগরণ হোক আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিময় সমাজকে নিজের পদতলে স্থান দেয়া, কারো পদতলে নিজের স্থান নয়। কোন কিছুর বিনিময়েই নয়।।
শেয়ার করুন: