মলি জেনান:
গত কদিন ধরেই প্রতিবেশি দুই দেশের কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক, ভৌগলিক, কূটনৈতিক ও মানবিক সম্পর্কের কাঁটাছেড়ার শিহরণ জাগানিয়া সিরিয়াল চলছে, যা নিয়ে সরগরম ভাতের প্লেট থেকে চায়ের কাপ পর্যন্ত। এমন সময় সিরিয়াল ব্রেক করে আমাদের নাম্বার ওয়ান শাকিব খান বাস্তবের ভিলেন হয়ে মিডিয়ায় ধরা দিলেন, শুরু হলো অন্য সিনেমা! আমরা আমজনতা এত থ্রিল কোথায় রাখি কোথাই থোই? তাই দিশেহারা।
এমন সময় আমি অন্য গল্প নিয়ে এসেছি। এখানেও শুরুতেই ভিক্টিম নারী!
এটাও শিহরণ জাগানিয়া গল্প। যা শুনে মানুষ হিসেবে আপনি শিহরিত হবেন, আপনার লোমকূপ দাড়িয়ে যাবে, মানুষ হিসেবে আপিনি লজ্জিত- অপমানিত বোধ করবেন, আপনার পরিচয় আপনার গ্লানির কারন হয়ে দাঁড়াবে।
আমারা চলে যাই খাগড়াছড়ির পানছড়িতে সেখানে পাহাড়িদের একটি গুচ্ছগ্রাম আছে নাম লোগাং। পাহাড়ি গৃহহীনদের জন্য সরকার কর্তৃক বানানো এ গুচ্ছগ্রাম। অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর, সেখানে থাকে হতদরিদ্র হাজার দেড়েক মানুষ। পাশেই আরেকটা গুচ্ছগ্রাম গড়ে উঠেছে সেখানে বাঙ্গালি সেটেলারদের বসতি। একেবারে বিপরীত দুই সংস্কৃতির দুই জাতীসত্বা’র অবস্থান পাশাপাশি। একদল পাহাড়ে প্রকৃতিতে বেড়ে উঠা প্রকৃতির সন্তান যেখানে নারীরা মুক্ত, স্বাধীন, কর্মঠ্। আরেক দল সমতল হতে সরকার কর্তৃক প্রতিস্থাপিত হওয়া বাঙ্গালি সেটেলার. যাদের মননে মগজে পুরুষতন্ত্রের পৈশাচ, যাদের কাছে নারী মানেই কম বেশি ভোগ্যপণ্য।
সেদিন ছিল ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল। দুদিন পরেই পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব ফুল বিজু, তারপর মূল বিজু। আর সব পাহাড়িদের মতই লোগাং এর পাহাড়িরা উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এর মাঝেই লোগাংয়ে তিনজন নারী তাদের ঘর থেকে একটু দূরে গেছে গরু চড়াতে। তার পাশেই যে বাঙ্গালি সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সেখান থেকে কয়েকটা যুবক দেখেছে এই পাহাড়ি নারীদের। প্রসাশনের ছত্র ছায়ায় থাকা সেখানকার বাঙ্গালি সেটেলারদের কাছে মুক্ত-স্বাধীন নাক চ্যাপ্টা পাহাড়ি নারীরা সবচেয়ে আমোদপ্রদ(!) ধর্ষণের বস্তু। তো ওরা হামলা করেছে সেই তিন নারীকে। ওরা পাহাড়ে বেড়ে ওঠা স্বাধীন নারী ভয় না পেয়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করতে গিয়ে হাতের খড়কাটা কাস্তে দিয়ে আঘাত করেছে, সেই আঘাতে একটা ধর্ষক রক্তক্ষরণে বিকেলে মারা যায়।
পাহাড়ি মেয়ের এতো সাহস সে চুপচাপ ধর্ষণ উপভোগ(!) না করে বাঙালি যুবককে কোপাবে? না হয় সে ধর্ষণই করতে গিয়েছিল? তাই বলে কাস্তে দিয়ে কোপ দিবে? এতো বড় দুঃসাহস!!
নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে যারা এতো সাহসের পরিচয় দেয় তাদের তো এওয়ার্ড পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কী হলো? মার শালা চাকমাদের, ধর্ষণ করতে গেছে বলে কোপ দেবে!! বাঙালি সেটেলার, এবং তাদের রক্ষাকর্তা পুলিশ-বিডিয়ার-সেনাবাহিনী সবাই মিলে অংশ হামলা চালায় পাহড়ি জম্মুদের গুচ্ছ গ্রামে। লোকজনকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আগুন দেয়া হয়। নিমেষেই পুড়িয়ে দেওয়া হয় আটশ’ ঘর, ঘরের ভেতর থাকা নারী-শিশু-বৃদ্ধ বেশিরভাগই মারা যায় পুড়ে। যারা ঘর থেকে বেরিয়ে পালাতে চেয়েছে, ওদেরকে মারা হয় নির্বিচারে গুলি করে এবং কুপিয়ে। প্রাণ নিয়ে যে কয়জন পালাতে পেরেছিল ওরা শুধু প্রাণটা হাতে করে পালিয়ে যায় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে।
ঘটনার পরদিন ঢাকা থেকে বিজু উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে একটা দল যায় – সেখানে ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সারা হোসেন ছিলেন, আনু মুহম্মদ ছিলেন, ছিলেন আরও কয়েকজন। ওঁরা খাগড়াছড়ি পৌঁছেই জানতে পারেন উক্ত হত্যাকাণ্ডের কথা, উনারা ঘটনাস্থলে যেতে চেয়েছিলেন। আর্মির লোকেরা তাদেরকে সেখানে যেতে দেয়নি। গোটা লোগাং এলাকাটা আর্মি সিল করে রেখেছিল কয়েকদিন ধরে। কিন্তু ওঁরা প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে ঘটনার ভয়াবহতা শুনেছেন। কিছু আলামত দেখেছেনও।
একজন নাকি লুকিয়ে একটি শিশুর পুড়ে যাওয়া কঙ্কাল নিয়ে এসেছিল ঢাকা থেকে যাওয়া ‘মেহমানদের’ দেখানোর জন্যে। মেহমানরা উৎসব দেখতে পারেননি, দেখেছেন একজন শিশুর পুড়ে যাওয়া কঙ্কাল! আমরা অনুমান করে নিই সেই পোড়া শিশুটি দেখতে কীরকম হয়েছিল!
এই ঘটনার আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি এমনকি সরকার এর সত্যতাও স্বীকার করে না। কেউ কি বলতে পারবেন যে- এই ঘটনাটিকে কেন আইনত গণহত্যা বলা হবে না? একদিনে চারশ মানুষ মেরে ফেলা? কিংবা তারও বেশি এইটা কি হাসি তামাশার ব্যাপার? পাকিস্তানী নরপিশাচরা ৭১‘এ মুক্তিযুদ্ধে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার দায় এখনো স্বীকার করেনি বলে আমরা গলা ফাটাই, কাগজ-কলমে ঝড় তুলি; অথচ একেবারে যুদ্ধবিহীন অবস্থায়, ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম অপরাধ করবার চেষ্টা করতে গিয়ে আহত ও মারা যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই যে গণহত্যা এর কী হবে? এর দ্বায় কে নিবে? এর বিচার কবে হবে?
জম্মু আদিবাসীদের হত্যাকান্ডের উপর একেবারে ভাসা ভাসা কিছু ধারণা ছিল, পরে বছর খানেক আগে Imtiaz Mahmood স্যারের একটা ফেইসবুক পোস্টে এসমন্ধে জানতে পারি। এর পরথেকেই বাঙ্গালি হিসেবে আমি খুব গ্লানি বোধ করতে থাকি, নেটে আরো খুজে বেড়াই কি ঘটেছিল সেদিন পরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন *সারভাইবল* কর্তৃক প্রচারিত একটি ধারাভাষ্য পাই।
ভিডিও লিংক-
https://www.youtube.com/watch?feature=share&v=nvV2gv9pD2k&app=desktop
পাই ‘ঠোঁটকাটা’ পোর্টালের প্রতিবেদন যেখানে আনু মুহাম্মদ স্যারের সাক্ষাতকার আছে।
আপনারা একটু কষ্ট করলে নেটেই খুঁজে পাবেন এমন বহু পাহাড়ি কিলিং এবং ধর্ষণের এর ঘটনা যা তথাকথিত ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে পরিচিত।
পাহাড় আমার খুব প্রিয় কিন্তু রাঙ্গামাটি, বান্দরবান খাগড়াছড়ির কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে যায় লোগাংএর কথা, চোখের সামনে ভাসতে থাকে পুড়ে যাওয়া মানুষ ও শিশুদের কঙ্কাল! আমি শিউরে উঠি আগুনের কাছথেকে বাঁচতে কিভাবে মানুষ ছোটাছুটি করছিল আর ছুটতে ছুটতে বুকে গুলি নিয়ে ঢলে পড়ছিল এটা ভাবতে গিয়ে। অসহায় হয়ে পড়ি, গ্লানি আর লজ্জায় নুয়ে পড়ি যখন দেখি সেই মানুষখেকো দানবদের পরিচয় আমার নিজের পরিচয়ের সাথে মিলে যায়!!
অব্যক্ত যন্ত্রণায় কুকড়ে উঠি যখন দেখি ফুল বিজু আর মুল বিজুর উৎসব রক্ত আর মানুষের পোড়া গন্ধে ভেসে যায়।