ফারহানা আফরোজ জাহান:
মেঝেতে খেলনা ছড়িয়ে খেলা আমার ছেলের খুব পছন্দের একটি কাজ। একদিন সে তার সবগুলো খেলনা মেঝেতে ছড়িয়ে খেলতে যাচ্ছিল, এমন সময় আমার বাসার সাহায্যকারী তাকে বললো, খেলনা ছড়ানো যাবে না কারণ সে ঘর ঝাড়ু দেবে ও মুছবে। ছেলে তখন খেলনা নিয়ে বিছানায় গেল। তার বাবা তাকে বললো, বিছানায় বাবু আছে (আমার আরেক ছেলে) তাই খেলনা নেয়া যাবে না। আমার ছেলে অসহায় ভঙ্গিতে খেলনা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আর অপেক্ষা করতে লাগল মুছানো ভেজা ঘর কখন শুকাবে।
আবার ছোট্ট বয়সের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে যদি কখনও জোরে কথা বলে বা চিৎকার করে তাহলে আমরাও জ্ঞানত বা অজ্ঞানত বলে উঠি, চিৎকার করবে না। বাইরে এমনকি বাসার নিচে খেলতে যেতে চাইলেও বেশিরভাগ সময়ই নিরাপত্তাজনিত কারণে না বলতে হয়।
এটা একদিনের কোন ঘটনা নয়। প্রায় প্রতিদিনই ওকে এই ধরনের অসংখ্য ঘটনার মুখমুখি হতে হয়। মাঝে মাঝে সে টিভি দেখার সময় হয়তো অন্য কেউ কিছু দেখতে আসে, সে উঠে গিয়ে ল্যাপটপ এ ঠাকুরমার ঝুলি দেখতে চাইলে তখন নানাভাবে তাকে অনুৎসাহিত করা হয় না দেখার জন্য।
আমার মতো অনেক মা – বাবাই হয়তো জেনে বা না জেনে সন্তানদের সাথে প্রতিদিন অসংখ্য বার “না” শব্দটি উচ্চারণ করে থাকেন। দেয়ালে আঁকবে না, পানি ফেলবে না, দুষ্টুমি করবে না, ঘর নোংরা করবে না, জিনিসপত্র এলোমেলো করবে না, বাইরে যাবে না, মা/বাবাকে বিরক্ত করবে না, এরকম হাজারো ‘না’ এর মধ্যে বড় হতে হয় আমাদের শিশুদের।
এই না শব্দটি ব্যবহার করে আমরা তাকে ভালো করার একটা বড় দায়িত্ব পালন করলাম বলে মনে করি। একবার ভাবুন তো, আমরা যে কাজগুলো করতে না বলি, সেই কাজগুলো যদি সে না করে, তাহলে সে কী করবে? দুষ্টুমি করবে না, লক্ষ্মী হয়ে থাকবে, ঘরে থাকবে, মা/বাবাকে বিরক্ত করবে না – তাহলে তাকে কি আর সুস্থ স্বাভাবিক শিশু বলা যাবে?
ছোট্ট এক অক্ষরের “না” শব্দটি মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে আপানার শিশুর জীবনে। ক্রমাগত ‘না’ এর মধ্যে বড় হতে থাকলে বাচ্চাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে এমন কথা হরহামেশাই শোনা যায়। শিশুদের জন্য “হ্যাঁ” বলার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক শিশু বিশেষজ্ঞ, শিশু মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন বিজ্ঞজনেরা।
আপনার বার বার উচ্চারিত “না” শব্দটি আপনার শিশুর মধ্যে থাকা কৌতূহলকে চিরদিনের জন্য শেষ করে দিতে পারে। বাচ্চারা ভালো কিছু করলে আমরা যেমন ভালো কথা বলি, তেমনি কোন ভুল করলে বা খারাপ কিছু করলেও তা থেকে ফিরিয়ে আনার পথও একই রকম হওয়া উচিৎ। যেমন বাচ্চা কথা শুনতে না চাইলে আমি তোমাকে শাস্তি দেবো বা মারবো এই জাতীয় কথা না বলে বরং কথা শুনলে তাকে একটা গিফট দেব, এইভাবে যদি বলা যায় তাহলে তার ফলাফলটা অনেক বেশি কার্যকর হয় বলে আমার মনে হয়। মা-বাবার শাসন বা মার বাচ্চারা খুব বেশীক্ষণ মনে রাখে না হয়তো নিজের প্রয়োজনেই। তবে উপহারের বিষয়টা কিন্তু ভালভাবেই মাথায় থাকে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে বাচ্চারা সব সময় ‘না’ শুনে বড় হয় তারা অন্য বাচ্চাদের চাইতে কম বুদ্ধিমান হয়। আপনি তার কাজে যখন বার বার ‘না’ বলতে থাকবেন, তখন সে তার নিজের উপর থেকে আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকবে এবং ভাববে তার পক্ষে ভাল কিছু করা সম্ভব নয়।
তবে হ্যাঁ, শারীরিক, মানসিক বা পারিপার্শ্বিকতার কারণে আমাদের পক্ষে সবসময় এমনকি বেশির ভাগ সময় হয়তো বাচ্চাদের সাথে ইতিবাচক ভঙ্গিতে কথা বলা হয়ে উঠে না। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের দুষ্টুমিতে অতিষ্ট হয়ে তাদের সাথে সঠিক ও কার্যকর আচরণটি করতে আমরা ভুলে যাই বা ব্যর্থ হই। তবে বাচ্চাদের দুষ্টুমি দেখলে তার প্রতি বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে কারণটি ভেবে দেখা দরকার।
আবার আমার ছেলের কথায় ফিরে যাই। আমার ছেলে একদিন ফ্রিজ খুলে আচার খেতে গিয়ে আচারের বয়াম ফেলে ভেঙ্গে ফেললো। আমি যথারীতি রাগ করে ভবিষ্যতে আর কখনও এই ধরনের কাজ করতে না বলি। এর পর সে এরকম আরও কিছু কাজ করে। তখন আমার মনে হলো নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। আমি ওর সাথে কথা বললাম, পাশাপাশি লক্ষ্য করলাম যে সে এই জাতীয় কাজ করে, যখন ওর প্রচণ্ড ক্ষুধা পায়। যেদিন বুঝেছি সেদিন কিন্তু আমার মধ্যে অনেক অপরাধবোধ কাজ করেছে যে আমার ছেলেটার কী পরিমাণ ক্ষুধা লেগেছিল এটা ভেবে।
আমরা আমাদের শিশুদের তাদের পছন্দমতো কাজ করার সুযোগ করে দিতে পারি। যেমন যে বাচ্চারা দেয়ালে আঁকতে পছন্দ করে তাকে জিজ্ঞেস করুন সে কী সাদা কাগজে নাকি বোর্ড এ আঁকতে চায়। দুটো অপশন দিয়ে মূলত আপনি আপনার পছন্দটাই তাকে জানালেন। অন্যদিকে দুটোর মধ্যে একটি বেছে নিয়ে সে কিন্তু ভাবলো আপনি তার মতামতকেই দাম দিলেন। তার খুশির মধ্য দিয়েই আপনি তাকে সঠিক পথটি দেখিয়ে দিলেন। এতটুকু তো করাই যায় আদরের সোনা মনিদের জন্য ।
গবেষণা কর্মী