জান্নাতুল মাওয়া:
১.
সে অনেক অনেক যুগ আগের কথা। শকুন্তলা আপন মনে বান্ধবীদের নিয়ে তপোবনে গাছের যত্ন করছিলেন। তার পরনের পোশাক খুব একটা সুবিধার ছিলো না। জানা যায়, কাপড় চোপড়ের বালাই ছিলো না তার। গাছের বাকল কোনরকম শরীরে জড়ানো ছিল। তার ওপর সে বান্ধবীদের সাথে অহেতুক হাসি ঠাট্টায় তপোবনের বাতাস ভারী করে তুলেছিল। রাজা দুষ্মন্ত ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। পথে শকুন্তলার মত উচ্ছল উজ্জ্বল প্রগলভা নারীকে দেখে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।
রাজাকে দোষ দেয়ার কোন কারণ নেই। রাজা একে পুরুষ মানুষ, তার ওপর রাজা, তারও ওপর শকুন্তলার পরনে সংক্ষিপ্ত পোশাক এবং সে বান্ধবীদের সাথে হাস্যরসে লিপ্ত। এমন বেপরোয়া নারী দেখলে কারোরই তো মাথা ঠিক থাকে না। তো রাজার মাথাও আউলা হয়ে গেলো। কিন্তু তিনি তো রাজা, খুবই চালাক। শকুন্তলাকে বললেন, তোমাকে এই বন জঙ্গলে মানাচ্ছে না। তোমার আসল জায়গা রাজপ্রাসাদ। আর কী সব ছাল-বাকল পরে আছো! তোমার উপযুক্ত পোশাক আছে রাজপ্রাসাদে। শুনে শকুন্তলা গলে আলু ভর্তা হয়ে গেলো। সে কম্পিত গলায় বললো, আমার বাবা আসুক, তিনি আমাকে তোমার হাতে তুলে দিবেন।
এদিকে রাজা তো অস্থির! ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিতে নিতে বললেন,
“মুনিবর বিলম্বে আসিবে।
ক্ষণেক বিলম্ব হৈলে মম মৃত্যু হৈবে।”
অর্থাৎ আরেকটু দেরি হলে নাকি তার মৃত্যু হবে। তাই তিনি শকুন্তলা কে বললেন, শাস্ত্রে আট রকমের বিয়ে আছে, এর মধ্যে একটা হল গান্ধর্ব বিবাহ। এই রীতিতে নিজেরা নিজেরাও বিয়ে করে ফেলা যায়। আর রাজা যেহেতু ক্ষত্রিয় তার জন্যে এই বিবাহ জায়েজ। বেদবাক্য শুনে শকুন্তলা রাজী হয়ে গেলো, তবে শর্ত দিলো যে তাদের যে সন্তান হবে সেই সন্তানকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার করতে হবে। দুষ্মন্তের তো তখন এত কিছু শোনার ধৈর্য নাই। সে সবকিছু না শুনেই ‘হ্যা’ ‘হ্যা’ করে গেলো।
অতঃপর,
কামে মত্ত ভূপতি করিল অঙ্গীকার।
গান্ধর্ব্ব বিবাহে হৈল মিলন দোঁহার।
কর্মসাধনের পর রাজার মনে পড়লো তার রাজ্যে অনেক কাজ পড়ে আছে। তাই সে শকুন্তলাকে বললো, এখন তো আমাকে যেতেই হবে, তবে আমি পরে লোক পাঠিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো। শকুন্তলা বিনা দ্বিধায় সব বিশ্বাস করে নিলো, বিশ্বাস না করা ছাড়া অবশ্য উপায়ও নাই। তো রাজা সেই যে গেলেন আর ফিরে আসার নামগন্ধও রইলো না। এদিকে শকুন্তলার চাঁদের মতো সুন্দর ছেলে হলো। সেই ছেলেরও ছয় বছর বয়স হয়ে গেলো।
এবার শকুন্তলার পিতা তাকে বললেন,
“পুত্র সহ যাহ তুমি রাজার আলয়।
পিতৃগৃহে কন্যা কভু সম্ভব না হয়।।
ধর্ম্মক্ষয় অপযশ হয় কুচরিত্র।
পিতৃগৃহে বহু ধর্ম্মে না হয় পবিত্র।”
শকুন্তলা ছেলে নিয়ে গেলো রাজার দরবারে। রাজা তখন তার সভা নিয়ে আরাম করে বসে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় অপ্রত্যাশিত উপদ্রবের মতো শকুন্তলা এসে একঘর লোকের সামনে নির্লজ্জের মতো আগের সব কথা বলা শুরু করলো। দুষ্মন্ত শকুন্তলার এই আচরণে খুব রেগে গেলেন। সভায় উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত, কিন্তু ক্ষিপ্ত স্বরে সমস্ত কিছু অস্বীকার করলেন।
রাজার এহেন আচরণে শকুন্তলা লজ্জিত, বিব্রত এবং যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে, রাজাকে বেশ অনেকগুলো কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন। তিনি বললেন,
“কি বাক্য বলিলা রাজা, নাহি ধর্ম্ম ভয়।
তুমি হেন মিথ্যা বল, উচিত না হয়।।
দৈবে সেই সব কথা কেহ নাহি জানে।
আপনি ভাবিয়া রাজা দেখ মনে মনে।।
জানিয়া শুনিয়া মিথ্যা কহে যেই জন।
সহস্র বৎসর হয় নরকে গমন।।”
এত কড়া কড়া কথার মাঝে শকুন্তলা এও জানিয়ে গেলেন যে তিনি সতী এবং পতিব্রতা। তাতেও দুষ্মন্তের পাথর মন গললো না। উলটো শকুন্তলার মায়ের পরিচয় তুলে ধরে সে বললো, এমন মায়ের মেয়ে আর কতই বা ভালো হবে। শুনে রাগে দুঃখে শকুন্তলার গলা বুজে এলো। সে বের হয়ে এলো সেই দরবার থেকে। তখনই ঈশ্বর ঘটনার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিলেন।
যখনকার কথা বলছিলাম তখনকার দিনের ঈশ্বর আজকের দিনের মত লাজুক ছিলেন না। তিনি সময়ে অসময়ে, দরকারে অদরকারে মানুষের মাঝখানে আবির্ভূত হতেন বলে শোনা যায়। তো শকুন্তলার নাকাল হাল দেখে আকাশের ওপর থেকে ঈশ্বরের স্বর ভেসে আসলো। তিনি রাজাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, রাজা যেন শকুন্তলাকে মেনে নেয়। কারণ শকুন্তলার সন্তানই তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি। (আর এই সন্তানের নাম ভারত, যার নামে আজকের ভারতের নাম হয়েছে।)
আকাশবাণী শুনে রাজা এবার পুরো ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেলেন। সভাসদদের বললেন, দেখেছো, আমি তো জানতামই সে আমার সন্তান। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম ঈশ্বরের আদেশের, নইলে তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করতে। তারপর রাজা শকুন্তলাকে ফিরিয়ে আনলেন, আর বললেন, তুমি যে আমাকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছো সে অপরাধ আমি মার্জনা করলাম। যদিও শকুন্তলা তার কাছে ক্ষমাভিক্ষা চায়নি। রাজা নিজে যে কতো অন্যায় করলো সেসব নিয়ে সে মোটেই লজ্জিত হলো না। জেনে শুনে যে শকুন্তলাকে সে জঘণ্য অপবাদ দিয়েছিলো, তার জন্যেও দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করেনি সে রাজা।
২
এরপর অনেক বছর গত হয়েছে। ভারতের নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে, জল যেন বেশি বেশি না গড়ায় সেই জন্যে অনেক নদীতে বাঁধও দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাজারা একই রকমই রয়ে গেছেন। তেমনই এক কিং এর স্ত্রী এসে ভরা মজলিসে আবার জানালেন তাঁর দুঃখের কথা। সেই একই ঘটনার আবার মঞ্চায়ন। শুধু এইবার লাজুক ঈশ্বর কোনো বাণী দেয়া থেকে বিরত থাকলেন। তবে রাজা আগের চেয়েও বেশি ক্ষিপ্ত, আগের চেয়েও বেশি স্মার্ট।
তিনি শরীর চর্চা করতে করতে বললেন, “ছেলে মেনে নিবো, কিন্তু বউ মেনে নিবো না। কারণ সে স্ত্রী হতে চায়নি, নায়িকা হতে চেয়েছে। সে আমার সম্মান রাখেনি।” যেন তিনি তার স্ত্রীর কতই না সম্মান রেখেছেন! যেন তিনি একাই নায়ক হতে চাইতে পারেন, তার স্ত্রী তো মেয়ে মানুষ, তার আবার এতো ক্যারিয়ার কিসের? বাচ্চা হয়েছে, শরীর স্থুল হয়ে গিয়েছে; যদিও বাচ্চা তার, তবুও ওই স্থুল নারীটিকে তিনি তার ধারে-কাছে দেখতে চান না।
যেহেতু এবার কোন দৈববাণী আসেনি তাই এবারের রাজা বেশ ঝাড়া হাত পা। আমাদের এবারের শকুন্তলা অবশ্য এতেই খুশি, রাজা যে অন্তত ছেলেটাকে মেনে নিয়েছেন তা-ই তার জন্যে অনেক। না ও তো মানতে পারতেন, পুরুষ মানুষ বলে কথা, তায় আবার রাজা!
(উল্লেখ্য, এটি শুধু একটি বিশেষ ঘটনার বর্ণনা নয়, এরকম ঘটনা ঘটেই চলছে; অহরহ। )
৩
আমি বড় অভিমান নিয়ে বসে আছি। মৃত্যু তো অনিবার্য। মৃত্যুর পরে ঈশ্বরের সাথে দেখা হবে আশা রাখি। সেইদিন তাকে জিজ্ঞেস করবো, হে ইশ্বর, রাজাদের ব্যবহার তো কিছুমাত্র পাল্টায়নি, তবে তুমি কেন পালটে গেলে? তুমি কেন হঠাত এতো লাজুক হয়ে উঠলে, কেন আর দুষ্ট রাজাদের শাসন করতে দৈববাণী পাঠাও না? আচ্ছা তুমি নাহয় পাল্টেই গেলে, তবে সন্তান জন্মের ধারাটিকেও পালটে দিতে! কেন সন্তানের জন্মে পুরুষের অংশগ্রহণ এতো কম করে রেখেছো?
এ অন্যায়, ভীষণ অন্যায়!