শাকিব খান ও পুরুষতন্ত্র ‘ঠিক’ পথেই আছে!

সুচিত্রা সরকার:

আজকেই প্রথম নয়। এমন কান্না আরো কতো দেখেছি। আগে এরকম কত কান্নার এক্সক্লুসিভের জোরে টিআরপি বেড়েছে। দর্শকের দু’মিনিটের ভাবনা আর তিন মিনিটের মনোরঞ্জনের খোরাক হয়েছে।

হাল আমলে মনে পড়ছে হ্যাপীকে। অনেক কাল আগে এরকম কাঁদতে দেখেছিলাম পপিকে।
ওদের উদাহরণই টানলাম। কথা হচ্ছে ‘বাজারের’ মেয়েকে নিয়ে। সেই কথায়, কথা টেনে, ঘরের মেয়েটিকে বসাবো কোন সাহসে! ‘বাজার’ অবধি তো ঘরের মেয়েটি পৌঁছায়নি!
তো, এত এত কান্না যে দেখলাম, তাতে হলটা কি! পপির সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। ছিল গণমাধ্যম। আর নানামুখী ফিসফাস!

হ্যাপীর সময় কান্না ছিল, গণমাধ্যম ছিল, আর এক ও অদ্বিতীয় সেই ‘ফিসফাস’! ‘বাজারের মেয়ে! নষ্টা মেয়েছেলে’!- ইত্যাদি ইত্যাদি তকমা!

ইত্যাদির পরে ‘তাহাদের’ নিত্যদিনের গল্পে আমাদের আর ইন্টারেস্ট থাকে না। সে জায়গায় দখল করে শেয়ার বাজার, বাজেট, মন্ত্রীপরিষদ, গার্মেন্টস খাতের লাভ- ক্ষতি! বা অন্য কোনো বিষয়! ঐ এক জিনিসে (বাজারি মেয়ের গসিপে) কে আর আটকে থাকে বলুন?

তারচে’ বড় কথা, বাজারি মেয়েরাও একটা সময়, সেই একই কথা আওড়ে যায়! ‘আমাকে ঠকানো হয়েছে! অন্যায়ের বিচার চাই, আমি নির্যাতিত!’ ঘরোয়া, শান্ত মেয়েটি ‘সহ্যের সীমার অসীমে’ গেলেও একই রকম ‘বকবক’ করতে থাকে!

তাই সমাজ, ‘বাজারি মেয়ে’ ও ‘লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে’দের ভাঙ্গা রেকর্ড বেশিদূর শোনে না! এসব ছিঁচকাঁদুনে মেয়েদের প্রলাপ গা-সওয়া! তন্ত্রটা জানে, ওরা আর কী কী বলবে! নিজের চরিত্র, পুরুষতন্ত্র ‘বেচারা’র জানা হয়ে গেছে অনেক কাল আগেই!

তাই সুবিচারের বদলে ‘ঘরোয়া ও বাইরে পা ফেলা’- দুই শ্রেণির মেয়ের কপালে একটিই রাজটিকা জোটে! ‘তুই খারাপ, নইলে গেলি ক্যান! তুই…।’

যখন অপু বিশ্বাস বলেন, আমি দশ মাসে অনেক কষ্ট করেছি। বলেন তো, একটা মেয়ে কোন লেভেল পর্যন্ত কষ্ট করতে পারে? আমার কী অপরাধ? আমি তো নিজের ক্যারিয়ার দিয়ে, জীবন দিয়ে, ওর ভালো চেয়েছি। বিনিময়ে ছোট্ট একটু সম্মান চেয়েছি!
সহানুভূতির আড়ালে থাকা পুরুষতন্ত্রটি মুচকি হাসে!

‘হিরো (নির্লজ্জ) নাম্বার ওয়ান’ বুক ফুলিয়ে বলে, এসব (অপু ও শাকিবের বিয়ে, সন্তানের কথা) জনসমক্ষে এনে হিরোর অসম্মান করেছে! স্বামীর অনুমতি ছাড়া, স্বামীর বিরুদ্ধে কথা বলে অন্যায়। পুরুষতন্ত্রের ‘হিরো’ ফাইনালি বলে দেয়, টাকা দিলেই, স্ত্রীর প্রতি মর্যাদা দেয়া হয়ে যায় (ভেবেছে ভাত দেয়ার মুরোদ হলেই, কিল মারার অধিকার জন্মায়)!

দম্ভের সঙ্গে উচ্চারণ করে, তিনি সন্তানের দায়িত্ব নেবেন, স্ত্রীর নয় (আসলে ছেলের দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না, পারলে সেটাই করতেন)! আর ‘চিকনি চামেলি’ হলেই মেয়েরা সিনেমার নায়িকা হতে পারে (সিনেমার নন্দনতত্ত্বটা শাকিবকে একটিবার পড়াতে পারলে, ভালো বোধ করতাম)।

‘তান্ত্রিক সাধু’ এবারও মুচকি হাসেন। যাক, ‘তন্ত্রের’ মন্ত্র ভালো মতোই রপ্ত করেছে ‘হিরো’ নাম্বার ওয়ান।

আর এইসময় উপলব্ধি করি, একটুও ভুল হয়নি! শাকিব তাঁর নিজস্ব পথেই আছেন। যে পথ মনে করে, ঘর আর বাহির- সবখানের মেয়েরা পুরুষের ‘দাস’ সমতুল্য!

আরেকটি ভালো খবর (বিপরীত অর্থ খুঁজুন) হচ্ছে এই যে, পুরুষতন্ত্রও তার অক্ষ-পথেই ঘুরছে। একচুলও নড়েনি! নড়লে নিশ্চয়ই এতদিনে এই ‘তন্ত্রের’ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেত ধসে! বদলে তো সেটা দেখছি, বহাল তবিয়তেই আছে! লাজলজ্জা হারিয়ে!

না হলে, কেমন করে, রোকেয়া, ওরিয়ানা ফাল্লাচি, মেরি ওলস্টোনক্রাফট এর এতো এতো কথার পরেও সমাজটা হাজার বছর পিছিয়ে যায়? কেমন করে, ধর্ষকের পক্ষে আইন হয়?
বলছি, এ বছরের বিবাহ আইনটার কথা। সেটা সংসদে পাশ হয়েছে। সেখানে বলা আছে, ‘কোনও বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনও নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে’ বিবাহ করা যাবে।
ক’দিন যেতেই একটা খবর পড়লাম। পাঁচ বছর আগে একটা মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে। কোলে বাচ্চা। পরিবার চেয়েছিল, ধর্ষণকারী তাকে বিয়ে করুক যেহেতু মেয়েটির সন্তানের বাবা)। আইনটার পরে, দুজনের বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ের পর ছেলেটি সুখে সংসার করবে, না অন্য কোন মেয়েকে ধর্ষণ করবে, সেটা দেখার দায়িত্ব আর নেই কারো। বা যদি বিয়ের পর ছেড়ে চলে যায়! বিয়ের সিলটা তো পড়েই গেছে, মেয়ের কপালে। এখন আর কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না, সন্তানের বাবার পরিচয় কি?

মেয়েটির কথা কল্পনা করতে কষ্ট হয়! কারণ আমার ‘যৌন নিপীড়নকারীকে’ যতবার দেখি, ততবার মুখে থু থু জমে যায়! সেইখানে ধষর্ণকারীর সঙ্গে বসবাস? ধর্ষককে রক্ষা করার বিধি তৈরি করলো সমাজ (বিয়ে হয়ে গেলে তো, মেয়েটি ধর্ষকের শাস্তি চাইতে পারবে না)।

সেই সমাজ, যেখানে কোন বাড়ির কোন মেয়েটা ধর্ষণ হয়েছে, দেখতে যায়। ধর্ষককে খোঁজে না। সেই সমাজে, যেখানে সন্তান মায়ের পরিচয়ে বাঁচে না। মায়ের দায়িত্ব শুধু প্রসব ও প্রতিপালন। সেই সমাজে, যেখানে ‘লাভ চাইল্ড’ (সব শিশুই তাই। অথবা তা নয়) ও ‘যুদ্ধ-শিশু’র মত বাজে টার্ম রেখেছে। সেই সমাজে, যে সমাজে সন্তান বাবার পরিচয়ের জন্য দরজায় দরজায় কড়া নাড়ে! সেই সমাজে, যে সমাজে অপরাধ করেও শাকিব খানরা গলা উঁচিয়ে কথা বলে।

তো সেই সমাজে, অপু বিশ্বাসদের আট বছর পরে হলেও মুখ খুলতে হয়! না হলে হয়তো, তাঁর সন্তানও ‘লাভ চাইল্ড’ এর তকমা পেয়ে যাবে।

এর মধ্যে আশার কথা এটাই, অপু বিশ্বাস বলতে পারছে, আমি স্বাধীন। আমার দায়িত্ব নেবার দরকার নাই। সন্তানের দায়িত্ব নিলেই হবে।

স্বস্তি এতটুকুই যে, রোকেয়া, মেরী ওলস্টোনক্রাফটদের এতো এতো কথা, এতো সংগ্রাম, এতো চেষ্টা- একেবারে বিফলে যায়নি! হাওয়ার গায়ে গড়িয়ে হলেও, কিছু মেয়ের মগজে সেগুলো পৌঁছেছে।

আশা জাগে, ঘুরে দাঁড়ানো এই মেয়েরাই একদিন, এমন একটা বলয় তৈরি করবে, যেটা পুরুষতন্ত্র আর শাকিবদের অক্ষ-পথটাকেই নিঃচিহ্ন করে দেবে। বদলে নতুন একটা অক্ষ-পথ তৈরি করবে, যে পথ সবার কথাই বলবে!

১১.৪.২০১৭
১১.২২ মিনিট
দারুস সালাম, ঢাকা

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.