আহসান হাবীব:
লেখার শিরোনামটি কোন সিনেমার নাম নয়, কিন্তু সিনেমা জগতের ’জনপ্রিয়’ একজন ‘নায়কের’ বাস্তব জীবনের কথা। যে কথার মধ্যে আছে একধরনের দাম্ভিকতা, অহম এবং ‘পৌরুষ’ শক্তি। আছে একজন নারীকে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত, অবজ্ঞা ও দেখে নেয়ার ‘ভিলেন’ মানসিকতা ও প্রচ্ছন্ন হুমকি।
বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় জুটিগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবেন শাকিব-অপু (শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস)। দর্শকদের অনেকেই ধারনা করতেন, শাকিব-অপুর পাস্পারিক সম্পর্ক বড় পর্দার দিগন্তের চেয়েও বড়। কিন্তু দর্শকদের ধারণা যে এতো নিষ্ঠুর হতে পারে তা অনেকেই হয়তো ধারণাও করতে পারেন নাই। অপু বিশ্বাস প্রায় একবছর ধরে পর্দার অন্তরালে। জীবনে সুখ প্রাপ্তির আশায় এদেশ থেকে ওদেশ দৌড়ে পালিয়েছেন। আমাদের মতো অনেক সাধারণ দর্শকই ভাবতে পারেন নাই এর পিছনে এতো বড় ঘটনা থাকতে পারে।
অনেক দিন পরে আজকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে অপু বিশ্বাস সরাসরি সাক্ষাৎকার দেন। যেখানে তিনি বলেন- ‘২০০৮ সালে ১৮ এপ্রিল তাঁদের বিয়ে হয়। শাকিবের ঢাকার বাসায় এই বিয়ে হয়। পরিবারের কাছের লোকজন সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের সময় তাঁর নাম হয় অপু ইসলাম খান। শাকিবের ইচ্ছাতেই এতোদিন বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর শাকিব তাঁকে বলেছেন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে। তাই তিনি ১০ মাস উধাও হয়ে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়টায় তিনি ভারত, সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককে ছিলেন। কলকাতার একটি হাসপাতালে তাঁর ছেলের জন্ম হয়, ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর।’
শুধু অপু বিশ্বাসের টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেখেই আমি এ প্রতিক্রিয়া লিখতে বসিনি। অপুর টেলিভিশন সাক্ষাৎকার চলাকালীন ও তার পরে কয়েকটি মিডিয়া শাকিব খানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছে। যেখানে শাকিব খান সরাসরি বলে দেন, ‘সন্তানের দায়িত্ব নেব, অপুর নয়’। তিনি আরো মনে করেন ‘এটি নাকি তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করার জন্য একটি চক্রান্ত’। অপু নাকি তার স্ত্রী হতে চান না, তিনি নায়িকা হতে চান। এই খবরগুলোর পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়াতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখেই আমি এ বিষয়ে লিখতে বসি।
এই সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ পাঠকদের একটি অংশ অপু বিশ্বাসকে ধুয়ে দিচ্ছেন। নষ্ট মেয়েদের জীবনে নাকি এমনটাই ঘটবে। অপুকে নাকি শাকিব খান নিজ হাতে ধরে নায়িকা বানিয়েছেন। সেই অপুই শাকিবকে পঁচানোর জন্য এমন নাটক, গল্প তৈরি করতেছেন। কেউ কেউ তো সংবাদ প্রচার করছেন ‘অপু বিশ্বাসের সন্তানের চেহারা নাকি দেখতে শাকিবের মতো না’।
আমাদের সমাজে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে গ্রহণ করে না। কিন্তু অপু বিশ্বাস তো শাকিব খানের বিবাহিত স্ত্রী। শুধু এটুকুই নয়, বিয়ে করার জন্য শাকিব খান অপু বিশ্বাসকে ধর্মান্তরিত করে হিন্দু থেকে মুসলমান করেছেন।
তাহলে সব দোষ কেন অপুর? আসলে সমস্যাটা অপু বিশ্বাসের না। সমস্যা আমাদের মানসিকতার, আমাদের সিস্টেমের। শাকিব-অপুর এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে টাকা দিয়ে কেনা পণ্যের চেয়ে অধিক কিছু মনে করে না। নইলে শাকিব কিভাবে টাকা দিয়ে অপুকে মুখ না খুলতে বলতে পারে।
শাকিব-অপুর ঘটনা এখানে একটা উদাহরণ। অপু বিশ্বাস টয়লেটের পাইপে সন্তান নামক রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড ফেলে না দিয়ে অনেক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন ময়লার স্তুপে, কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে, ওয়াসার ড্রেনে, হাসপাতালের ঝুড়িতে যে সন্তানরা হারিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা একটু ভাবুন। পিতৃত্বের পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক অনেক ক্ষমতাবান পুরুষের ভয়ে কত নারী যে নিজের সন্তানকে ভোরের আলো দেখার আগেই হত্যা করেছেন, কত নারী যে নিজে আত্মহত্যা করেছেন সেগুলো মনে করলে শাকিবের এহেন আচরণকে অস্বাভাবিক মনে হয় না।
এটা শাকিব, রাকিবের প্রশ্ন না। আবার এটা অপু-বুবলিরও প্রশ্ন না। এটা নারীতন্ত্র কিংবা পুরুষতন্ত্রও না। এটা একটা মানসিকতা। একজন নারী হয়েও শাকিবের মা কিংবা তার হবু নায়িকা বুবলির প্রতিক্রিয়া যেমন আমরা আঁচ করতে পারি। তেমনি ফেসবুক প্রতিক্রিয়ায় আমরা শাকিবকে ধন্যবাদ দিতে দেখি এই বলে যে ‘সংসার করো আর না করো, একজন মালাউনকে তো মুসলমান বানাতে পেরেছ’।
এসব কিছুই একজন নারীকেই অধিক সামাজিক, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়।
দশ মাস বাচ্চাটিকে পেটে করে শাকিবের কথার প্রতিদান দিতে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারত ঘুরে বেরিয়েছে। আর এখন শাকিব বলছে ‘সন্তান তার, কিন্তু অপু তার স্ত্রী না’। এটা বলার পরেও সব দোষ অপুর! আহ আমাদের সমাজের মানুষের ন্যায়বিচার!! আমার মনে হয় যদি আধুনিক প্রযুক্তিতে বাচ্চার পিতা-মাতা সনাক্তকরণ কোনো পদ্ধতি না থাকতো, তাহলে শাকিব সন্তান পরিচয়ও হয়তো দিতেন না।

আসলে এরা নারীর শরীরকে একটি ভোগের বস্তুর বাইরে আর কিছু হিসেবে দেখেন না। অপুর ঘটনা দেখে অন্যান্য নারীদের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে। যদি সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্রের শৃংখল থেকে পুরোপুরি বের হতে না পারেন, তাহলে কোন পুরুষকে সস্তা উপায়ে নিজের শরীর দিবেন না। এই পুরুষ শুধু একা না। যখন এরা চিপায় পড়ে যায়, তখন এরা একসাথে পরিবারের সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এই পুরুষদের হয়ে কথা বলে। এই পরিস্থিতিতে একজন নারী সমাজ, রাষ্ট্র তো দূরের কথা নিজের পরিবারকেও পাশে পায় না।
এই ধরনের অন্যায় ও অনৈতিক মানসিকতার মানুষ বড় নিষ্ঠুর হয়। এরা অন্যের জীবন নিয়ে হোলি খেলায় নিমজ্জিত হতে আনন্দ পায়। নিষ্ঠুর এই খেলার এখনই সমাপন ঘটাতে না পারলে এই গোষ্ঠী রাষ্ট্রের গলা টিপে ধরবে অচিরেই। এরা বড় ভয়ংকর। এরা নিজেদের লেবাস খুলে যাওয়ার ভয়ে যে কোনো কাজ করতে পারে অনায়াসে। এরা সিদ্ধহস্ত। এরা চতুর। এরা ধরা পড়ে না। এরা একজন কিংবা দুজন নয়। চোখের সামনে পর্দার মহরটা সরিয়ে ফেললেই আপনার চারপাশেই এদের দেখতে পাবেন।
লেখক: সিনিয়র লেকচারার, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। ইমেইল: [email protected]