: আমার চাইতে মাত্র ১৪ বছরের বড় পাত্রের সন্ধান আব্বা নিয়ে এসে আমাকে যখন ফটো দেখতে বলেন, আমি কিছু বলি না। আব্বার কথার বাইরে কি আমার বলার কিছু আছে?এমন না যে আব্বা আমাকে ভালোবাসেন না, স্নেহ করেন না। সবই করেন। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও যথেষ্ট ভালো।
সমস্যা আব্বার হার্টে। একবার এটাক হয়েছে। সব সময় দুশ্চিন্তা করেন। আমি শুধু আব্বাকে বলি, তুমি আর আম্মা যা ভালো মনে করবে, সেটাই আমি করবো। শুধু আমার লেখাপড়া যেন না থামে আব্বা, এই শর্তটা তুমি দিয়ে দিয়ো। আমি প্রচলিত অনেক ছাত্রছাত্রীর চাইতে নাকি পড়ালেখায় উৎকৃষ্ট মানের অধিকারী। এসব কথা শুনতে শুনতেই কেমন করে যেন এসএসসিতে মেধা তালিকায় চলে এসেছি তাও বিজ্ঞান শাখা থেকে। এইচএসসি দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি। এর ভেতর আব্বার এই প্রস্তাব। আমার যুক্তিবাদী মন জানে পাত্র আমার চাইতে অন্তত আট দশ বছরের বড় না হলে তো হবে না, তাকে কাজ করতে হবে ও প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, সেখানে ১৪ বছর হতেই পারে।
রেজাল্টে দেখা গেল আমি আবারো মেধা তালিকায়, অংক আমার নেশার মতো লাগে। অনাড়ম্বর বিয়ের দিন স্টেজে বসে আপাত গম্ভীর এক ভদ্রলোককে দেখি যার সাথে আমার আগামী জীবন কাটাতে হবে। এই অংক মিলবে কিনা, ইউনিভার্সিটিতে ম্যাথমেটিক্স সাবজেক্ট পাবো কিনা এসব ভাবতে ভাবতে সদ্য ঊনিশে পা রাখা আমার তেত্রিশে পা রাখা মুস্তাফিজের সাথে কবুল হয়েই যায়।
শ্বশুর বাড়ীর আদব কেতা রান্না শিখতে শিখতে আর তেল মশলা কখনো জামার ওড়নায়,কখনো আনাড়ী হাতে পরা শাড়ীর আঁচলে মুছতে মুছতে আমি ঘরকন্না শিখি,ভার্সিটিতে যাই অংকশাস্ত্র নামক নেশা পান করতে করতে।
এই রঙ এর কাপড় পরে অমুক অনুষ্ঠানে যেতে হয়,এভাবে পরতে হয়,ওভাবে খেতে হয়,এভাবে হাসতে হয়,ক্লাসে লাইব্রেরিতে কতক্ষণ থাকতে হয় এমন নানাবিধ ফিরিস্তি শুনতে শুনতে আমার মানিয়ে নেয়া মন কোন বাদ প্রতিবাদ করে না।
অংক আমার ভালোবাসা, মুস্তাফিজ আমার অভ্যাস, আব্বার পরে নতুন অভিভাবক। শ্বশুর আব্বা শাশুড়ি আম্মা মোটের উপর ভালো, তাদের অকারণ বদমেজাজি, অধিকার প্রিয় ছেলের চাইতে তো নিঃসন্দেহে ভালো।
প্রথম বছর অনার্স পার করতে করতে রাতের শয্যার উপহার আমার গর্ভে হাত পা নাড়া শুরু করে।
আলভি আমার কোল আলো করেছিলো কিনা আমি জানি না। তবে আমার দায়িত্ব দৌড়ঝাঁপ চতুর্গুণ হয়ে গেল।
ভার্সিটি, আলভি, রান্নাসহ আরো কাজ সামলাতে সামলাতে, ব্যালেন্স করার হিমশিম খেলা মাঝে মাঝে স্নায়ুর উপর দিয়ে যেতে থাকে। বাচ্চার কান্নায় ঘুম হয় না এ উসিলায় মুস্তাফিজ দিনের অফিস সুন্দরভাবে করার জন্যে নিয়মিত বিরতিতে আলাদা রুমে ঘুমানো শুরু করতে নিজেকে কেন যেন নির্ভার লাগে।
সবার সব জল্পনা কল্পনা অসহযোগিতাকে পেছনে ফেলে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াতে নিজের আত্মবিশ্বাসে নতুন পেইন্ট পড়ে আমার। আলভি তিন বছর, মুস্তাফিজ অতিথি বেশে ঘরে, শ্বশুর শাশুড়ি দিনের বেলা নাতিকে দেখভাল করাতে তাও সামান্য স্বস্তি। এমন করে এমএসসি ও শেষ হয়। ম্যাথ আমার রক্তে। ইউনিভার্সিটিতে একজন বন্ধুও হয়নি, আমার যাওয়া আসা রেজাল্ট ছাড়া আর কোনদিন কেউ লক্ষ্য করেছে কি না কে জানে!
আলভির সাথে মুস্তাফিজ এর সম্পর্ক কী আমি ঠিক বুঝি না, এও বুঝি না মুস্তাফিজের অফিসে আসলে এমন কী হয়েছে যে কারণে ও রাত দশটার আগে বেশির ভাগ দিনই বাসায় আসতে পারে না।
তবে মেজাজ ভালো থাকলে মুস্তাফিজ আলভির সাথে খেলে,আলভিও সে সময় খুব উপভোগ করে।
আগে তাও ইউনিভার্সিটি যাওয়ার কারণে বাইরের দুনিয়ার কিছু দেখা হতো। এখন ঘর-আলভিকে সামলে, টিভি দেখা, বই পড়া আর লুকিয়ে যেসব চ্যাপ্টার ইউনিভার্সিটিতে থাকতে পড়া লাগেনি, সেগুলো সলভ করে দিন পার করি।
দিন দিন মুস্তাফিজের ব্যবহার কেন যে এত খারাপ হতে থাকে তা আমার জ্ঞানের বাইরেই থাকে।
আমি আমার মাকে একদিন বলি মুস্তাফিজের কথা, তার চাল চলনে পরিবর্তনের কথা।
আব্বার হার্টের কথা চিন্তা করে ‘ভালো আছি সুখে আছি’ ছাড়া যা কখনো বলি না, তা আমার একমাত্র জানালা কথা বলার, আম্মাকে বলে ফেলি আলভির ছয় বছর বয়সের সময়ে। আম্মা চিন্তিত হোন, কিন্তু তেমন কোন পরামর্শ দিতে পারেন না।
চিন্তার ষোলকলা পূর্ণ হয়, বিনা নোটিশে মুস্তাফিজ রুহিকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে এলে।
মুস্তাফিজ ভেবে নেয় চুপচাপ আমি কিছুই বলবো না, রুহিকে নিয়ে মুস্তাফিজ আরেক বাসায় উঠে যায়। আমি শ্বশুর শাশুড়ির সাথে আলভি নিয়ে থাকি। ২৫ বছর বয়সকে ৫২ বছরের মতো মনে হয়।
যখন যেভাবে ডাকা তখন সেভাবে আলভিকে দেখাতে মুস্তাফিজের কাছে নিয়ে যাওয়া, এ রুটিনে যখন আমি ক্লান্ত-আব্বা সমন পাঠান নাতি নিয়ে তার কাছে চলে যাবার। আমি বুঝি একজনকে আরেকজনের জীবনভর ভালো লাগবে এমন হবার কোন কারণ নেই-তবে আমার প্রতি করা মুস্তাফিজের অভিযোগও শুনতে পেলাম না। এ করো না, সে করো না, এতো পড়া কিসের এসব শুনতে শুনতে তো আমি কখনো একটা শব্দও উচ্চারণ করিনি।
আলভিকে নিয়ে বাবার বাসায় এসে এমন কোন স্ট্রাগল আমার নেই। পড়ালেখার বদৌলতে বিসিএস পার করতে আমার কোন অসুবিধাই হয় না। আব্বা আম্মাও আমাকে আবার বিয়ে দেবার গান করেন না একদম। এমন নিস্তরঙ্গ অনাড়ম্বর বয়ে যাওয়া জীবনের কাহিনী লিখার আদতে কোন দরকার নেই।
লিখতে হলো আলভির জন্যই।
চুপচাপ আলভি, মায়ের বুক ঘেঁষে ঘুমানো এগারো বছর বয়স পর্যন্ত আলভি কখন এমন হাঁটা শিখেছে আমি জানতেও পারিনি।
আলভি তার ষোল বছর বয়সের জন্মদিনে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া অভ্যাসে বাংলা ইংলিশ মিলিয়ে আমার আব্বা আম্মার সামনে বলে ফেললো এক ভয়ানক কথা-নানাভাই, আম্মুর যে বয়স সে বয়সে অনেকে জীবন এর আরেক অধ্যায় শুরু করে। আমার ‘এ’ লেভেল শেষ। মামা, খালামণি সবাই সবার নিজের সংসারে ব্যস্ত। দু এক বছরের ভেতর আমার ‘ও’ লেভেল কমপ্লিট হবে। তোমাদের ইচ্ছা মতো বাইরেও চলে যাবো। আম্মু কি শুধু জব নিয়ে থাকবে? আম্মুর লাইফ পার্টনার খোঁজা দরকার।
সিয়াটল থেকে দেশে সেটল করার উদ্দেশ্যে আসা আমার বড় খালার ননদের ছেলে জুনায়েদের সাথে আলভি আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। আলভি জুনায়েদকে মামাই ডাকে।
পরিবেশ পরিস্থিতি, আব্বা আম্মার বয়স এসব বিবেচনায় জুনায়েদ আলভির নানার বাসাতে থাকে।
মাঝে মাঝে জুনায়েদ আর আলভির কথার সময় শুনি আলভি বলে ‘মামা, ধর্মমতে আম্মুর বিয়েটা নানা-নানুর আরো আগেই দেয়া উচিৎ ছিল।’ জুনায়েদ ঘর ফাটিয়ে হাসে আর আলভিসহ আইপিএল দেখতে থাকে।
লাটভিয়াতে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাবার তিনমাস আগে, এক বিকেলে আর আলভি ফিরে আসে না। আলভি যাদের সাথে নামায পড়তো বাসার সামনে মসজিদে তাদের মধ্যে তিনজন রাহাত, তারেক এবং ইরফানকেও পাওয়া যায় না।
আমরা প্রথম প্রথম ভাবি বুঝি এডভেঞ্চার করার জন্য একসাথে বন্ধুরা কোথাও গেছে। মোবাইল ফেলা বাসায় প্রত্যেকের, টাকা ও তেমন নেয়নি, কাপড় যেমন ছিল তেমন আছে। জুনায়েদ আর আমি আত্মীয়-স্বজন কোচিং সব খুঁজে পুলিশের কাছে গেলাম। খোঁজ চললো, মুস্তাফিজ আমাকে যা না তা বললো। তার ছেলেকে আমি আর জুনায়েদ মিলে গুম করেছি এমনও শুনলাম।
ছয় মাস পর ইরফানের লাশ এলো সিরিয়া থেকে, গোপনে। চেনা পরিচিত দেশ চোখের সামনে অন্যরকম হয়ে গেল।
এক বছর তিন মাস পর আলভির সাথে আমার দেখা হয়েছে, হাসপাতালে পুলিশের কাস্টডিতে-আলভি আমাকে শুদ্ধ বাংলায় একটা চিঠি লিখেছে, সে চিঠি ও কিভাবে লিখলো আর আমি কিভাবে পেলাম তা নাই বা জানলো কেউ-
প্রিয় মা,
তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আমি জানি। একে একে হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবে,আবার নাও পেতে পারো।
তোমার মনে আছে আম্মু,আমি তোমার জন্য সন্ধ্যা নামা শহরে কিভাবে অপেক্ষা করতাম তুমি বাসায় আসার! এখন এই বন্দীদশায় সেভাবেই দিনগুণি তোমাকে দেখার।
এই একবছর তুমিও আমার জন্য অপেক্ষা করেছো আমি জানি।
এ খেলা কিভাবে শুরু হয়েছিলো আমি বলতে পারি না। ওদের কথা তো ভালোই লাগতো, আল্লাহর নৈকট্য লাভের কথা, ন্যায়ের পথে চলার কথা, নামায রোজা এগুলো করার মিষ্টি কথা আমার খারাপ লাগার কোন কারণ নেই। ওদের কথা শুনতে শুনতে এমন এক মুহূর্ত এলো, তখন মনে হলো আসলেই এ পৃথিবীর সবটাই মায়া।
পৃথিবী জুড়ে যা চলছে তা আদতেই ঠিক না।
আল্লাহর দুনিয়ায় তাঁর হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের মতো তরুণদেরই কোরবানী দিতে হবে আপন আপন প্রাণ।
সবাই বলে ব্রেইন ওয়াশ, আজকে হাসপাতালে শুয়ে মনে হচ্ছে আমার ব্রেইন কোনকালে থাকলেও মন ছিল না, সেটাই সবচাইতে ভয়ংকর দিক।
মন থাকলে আম্মু যে আমি তোমার গায়ের সুবাস ছাড়া এগারো বছর পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি, যে আমি নানার বয়স আটাত্তর তাই তার সাথে মসজিদে যেতাম তাকে নিরাপদে আনার জন্যে, সে আমি কীভাবে এতো এতো মানুষের মরণের কারণ হতে পারলাম!
তোমাকে অনেকেই অনেক কথা বলবে, সারাজীবনের স্বল্পভাষী তুমি চুপ করে শুনে যাবে সেও আমি জানি।
কোরআন শরীফে হাত রেখে আমি ওদের সাথে থাকার শপথ নিয়েছিলাম, তবু মাঝে চেয়েছি সব ছেড়ে তোমার কাছে আসতে-আমাকে চামড়া তুলে লবণ লাগানোর ভয় যেমন দেখানো হয়েছে, তেমনি তোমাকে আর জুনায়েদ মামাকে মেরে ফেলবে এমনও বলেছে।
আম্মু, পৃথিবী জুড়ে সেভাবে কিছু হচ্ছে না, কিছু মানুষ এসব করছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। পুরুষ নারী না বুঝে তাদের অন্তর মোহর করে অন্যের প্রাণ নিতে ছুটছে।
আম্মু, তোমার কসম যেসব আহাম্মক পারিবারিক সৌহার্দ্যের অভাবকে আমার বিচ্ছিন্নতার কারণ ভাবছে, তারা ছাগল ছাড়া আর কিছু না। আমার জীবনে কোন কিছুর অভাব না থাকা, সব পরিকল্পনা মাফিক চলাই হয়তো আমার এই হঠকারী কাজের পেছনে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
ও আম্মু, আমি কিন্তু নিজ হাতে কোন মানুষ মারিনি, তার আগেই আল্লাহর অশেষ রহমতে ধরা পড়েছি।
আম্মু, আমার হয়তো বাকী আয়ু জেলেই কাটবে যদি বেঁচে থাকি।
আমি তোমাকে জুনায়েদ মামাকে নানা নানুকে অনেক ভালোবাসি, তোমার গন্ধ আদর সব আমার পাশেই আছে।
এ ভুবনে যদি নাও হয়, তোমার আমার যেন সে ভুবনে দেখা হয়। আমার তোমাকে ছাড়া আর কিছু চাই না।
কখনো নিজেকে ব্যর্থ ভাববে না, তুমি মা-বাবা দুজনের ভূমিকা একই সাথে পালন করেছো।
যদি দায় কারও থাকে সে দায় (এটা তুমি এলে আমাকে দেখতে চুপিচুপি বলবো)।
তোমার আলভি
ম্যাথে পড়া আমি, এর চাইতে ভালো কি আর লিখতে পারি! নিজের দোষ মনে হয় সারাজীবন সব চুপচাপ মেনে নেয়া। এই যে এই চিঠি হাতেও আমি বসে আছি নিঃশব্দ, অচৈতন্যপ্রায়-একদিকে আলভিকে জীবিত দেখার আনন্দ, অন্যদিকে আলভির শাস্তির ধারাগুলো আওড়াচ্ছি।
বন্ধ বেহালার সুর
স্বর্গ থেকে নামবে
ঊর্বশী মেনকা হুর
শুধু আমার আলভি
জীবন-মৃত্যুর
মধ্যখানে একদড়ি, দূর।
-সংগৃহীত