পৃথা শারদী:
“নিজের পছন্দ মতো চলাফেরা করে, একা একা! কী সাহস ! মেয়ে মানুষ তাও ,বন্ধু একটাও মেয়ে না!তাকায় কিভাবে দেখেছ ? মনে হয় ,চোখ দিয়ে খুন করবে। এরা খারাপ মেয়ে ! নইলে এমন করে নাকি!” বলা বাহুল্য, হাত-পা-চোখ-মুখ থাকা সত্ত্বেও যে মেয়ে একা ঘোরে, যার অনেক ছেলে বন্ধু, সে অবশ্যই খারাপ মেয়ে।
“উলটা পালটা জামা পরে, ওড়না এই জীবনে দেখলাম না বুকের উপর আছে। পরে হাতকাটা ব্লাউজ, নাভীর নিচে শাড়ী গোজে। ছেলে ঘেঁষা, কই না কই যায় খবর থাকে না। যদি বলি, “এমন জামা কেন পরো “ বলে, ইচ্ছা ! এরা তো বেলেল্লাপনা করে দিন কাটায়, মেয়ে আসলে খারাপ। ছেলেদের এসব উল্টাপালটা কাপড় পরেই তো কাছে টানে, আর ফায়দা লোটে”।
বলা বাহুল্য,যেসব মেয়ে শরীর ঢাকা কাপড় পরেন না, যারা গরমের দিনেও জোব্বা জামা পরেন না, নিজেদের আরামের জন্য হালকা পাতলা জামা পরেন, তারা শরীর দেখাতেই এসব করেন, তারা খারাপ মেয়ে।
“আরে, মেয়ে কালো, তাও মেকাপ দিয়ে সাদা হয়ে সবার সামনে ঘোরে, বুঝো নাই? ছেলে পটানোর ধান্দা, খারাপ স্বভাব আছে আরকী, ছোকছোকানি। ছেলে দেখলে হুঁশ থাকে না। পড়াশুনাতে ভালো? হেহ! সবার সাথে খাতির করে চললে ভালো নাম্বার তো পাবেই”।
“মেয়ে তো ভাই ছেলে পটাতে ওস্তাদ! আরে,দেখতে ভালো তো ! ছেলেরা তো তাকাবেই! এইটা দোষের কিছু না, মেয়ে তো নিজেরে সামলায় চলবে, সুন্দরী মাইয়া নিজেই ছেলেদের সাথে ঘুরে বেশি। খারাপ চরিত্র আসলে। ছেলেদের রূপ দেখায়, আনন্দ পায়”। বলা বাহুল্য, মেয়ে যদি বেশি সাজে, সে খারাপ, কারণ বেশি সাজগোজে ছেলেরা আকৃষ্ট হয় বেশি। ফুলের ঘ্রাণে ভ্রমর আসবে, এখন তাই ফুলের সব দোষ, ভ্রমর তুলসীপাতা।
“ওই মেয়ে আমার সাথে থাকে নাই, আমি নাকি ডোমিনেটিং। হেহ! নিজের প্রেমিকারে দেখে রাখবো না? আমি ছাড়া কত ছেলে নাকি তার বন্ধু, এতো কী কথা বন্ধুর সাথে, ওর আসলে চরিত্র ভালো ছিল না, ভালো হইসে ব্রেকাপ হইসে, নষ্টা একটা”। বলা বাহুল্য, প্রেমিকের আজাইরা এবং পিকুলিয়ার ডোমিনেটিং স্বভাবকে পাত্তা না দিয়ে সম্পর্ক কেটে দিলে মেয়েটি খারাপ চরিত্রের অধিকারী হোন।
“তুমি জানো ওই মেয়ের ব্যাপারে কিছু? জানো কোন বিষয়ে লেখাপড়া করেছে?হু, হু ! কী জানি নাম, আর্কিটেকচার না কী! আরে! ওইখানে মদ গাঁজা না খেলে ডিজাইন আসে না, এই মেয়ে খারাপ, ঘুরতে পারো, শুতেও পারো এদের সাথে। তবে সাবধান! জড়িয়ে যেও না যেন! এই মেয়েরা কিন্তু ছেলে নাচাতে ওস্তাদ”! বলা বাহুল্য, শুধু আর্কিটেকচার না, চারুকলা, ফ্যাশন ডিজাইনিং এসবও খারাপ চরিত্রের মেয়েরা পড়ে কিংবা এসব বিষয়ে পড়লে মেয়েরা নষ্ট হয়।
“আরে! ওই যে ওই পুরস্কার পাওয়া মেয়েটাই তো, না? কীভাবে পেয়েছে জানো না তো! বসকে হাত করেছিল, নইলে এমন কঠিন কাজে কিভাবে এই দু’রত্তির মেয়ে পুরস্কৃত হয়! চরিত্র খারাপ, বোঝো না? নাহলে এসব জায়গায় উঠে যাওয়া এত্তো সোজা না। “বলা বাহুল্য,আজকাল কোন মেয়ের মাথায়ই মেধা থাকে না, তারা যদি প্রমোশন পেয়েও যান, তাহলে পান বসের সাথে ঢলাঢলিতে, অতএব এরা খারাপ মেয়ে, কারণ বস নামক প্রাণীরা কাজ না দেখে শুধু শরীর দেখেই প্রমোশন দেন।
“মেয়ে সাংবাদিক না পুলিশ জানি, ডিউটি নাকি রাতে করে ! আরে যে মেয়ে রাতে বাইরে থাকে , সেই মেয়ে ভালো নাকি! তুমি তো দুনিয়া দেখো নাই, মেয়ে খারাপ, মেয়ে খারাপ। সংসার নাই, ঘর নাই তো এইজন্যই। এহ হে! মিডিয়ার মেয়ে! তার সাথে এতো কী? আরে, মডেল নাকি মেয়ে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! রাতের কারবার ছাড়া উঠতে পারে না এরা, খারাপ মেয়েদের দল“; বলা বাহুল্য, রাতের কাজ মানেই খারাপ কাজ, মেয়ে ধান্দাওয়ালী।
“আরে, আরে, আরে, কারে বিয়ে করবা তুমি! এই মেয়েকে! জানো এই মেয়ের যে সম্পর্ক ছিলো?আরে! না না, তোমার সম্পর্ক থাকলে, থাকতেই পারে, তাই বলে জেনে শুনে এমন মেয়ে ঘরে আনবা? অন্য ছেলের ছোঁয়া মেয়ে? এরা কিন্তু ভালো চরিত্রের হয় না, বুঝে নিও“; বলা বাহুল্য, একাধিক প্রেমে জড়ানো কোনো মেয়ে অবশ্যই নষ্ট চরিত্রের অধিকারিনী, উনারা বিছানায় যান এবং উনারা অসতী।
“ওহ! ঐ মেয়ে ! আরে মুখে মুখে কথা বলে, কোন কথা মাটিতে পড়তে দেয় না, এসব মেয়ে সাথে নিয়ে ঘুরার জন্য ভালো, ভালো সঙ্গ পাবে, দেখবে খুব ইজিগোয়িং, এদের সাথে প্রেম করবা। এরা ঘরের বউ হবার জন্য ভালো না। বিয়ে করে ভালো থাকতে পারবা না, তোমার মা’কে শান্তি দিবে না, তোমাকেও জ্বালায় মারবে, এগুলা খারাপ মেয়ে, মাথা উঁচু করে থাকবে সবসময়, তোমাকে ডোমিনেট করবে, এদের সাথে কিন্তু ঘর বাঁধতে যেও না”। অর্থাৎ বন্ধুবতসল কোন মেয়েকে প্রেমিকা করা গেলেও ঘরের বউ করা যায় না, মা-বাবার সামনে ভদ্র মেয়েকে নিয়ে যেতে হয়, ইজিগোয়িং, ফ্রেন্ডলি মেয়েরা ঘরের জন্য ভালো হয় না।
“মেয়ে ক্যারিয়ারিস্টিক, বুঝলেন? এই মেয়ে খুব স্বার্থপর, ক্যারিয়ারের জন্য সব করতে পারে। এই মেয়ের সাথে কথা বলবেন না ভুলেও, আপনার মগজ ধোলাই করে দেবে, এরা তেমন “ভালো” হয় না। মেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করেছে? সিজিপিএ এতো ভালো! না! না! মেয়ের বিদেশে কার না কার সাথে সম্পর্ক ছিলো, কে জানে? থাক বাবা ! বিদেশের মতে চলা মেয়ে ভালো হবে না”। ক্যারিয়ারিস্টিক মেয়েরা ভালবাসতে জানে না, তাদের মনে সংসার করা ইচ্ছা থাকে না, তারা খারাপ। তারা শুধু টাকা চিনে। আর বিদেশী মেয়ে মানেই তো বিদেশী রোগ, বলার আগেই এরা খারাপ।
“আমার বৌমা অফিস করে, আমার ছেলের দিকে তাকায় না, আমার ছেলে শুকায়ে কী হয়ে গেল! নাতনীটার পড়াশুনা হয় না। আমার কপালই খারাপ, বউ যদি জানতাম এমন ঘুরে বেড়ায়, বিয়েই করাতাম না! কাজের মেয়েই সব করে, বৌ তো শুধু রাতে এসে একটু হাতে হাতে ঘরের কাজ করে“; এমন ছেলেকেও আজকাল বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় যারা কিনা নিজেরা নিজেদের যত্নও নিতে পারে না, এমন অকর্মার ঢেকির সাথে থাকতে গিয়ে হাজার কাজ করে বাইরে থেকে ফিরে আসার পরেও শুনে যেতে হয়, হুম,পোলার বউ খারাপ ।
“ভাবী , ওই যে পাশের বাসার মহিলা আছে না? উনি একা একা বাজার করে, একা একা শপিং এ যায়, আবার কলিগেরা উনার বাসায় আসে, উনি বেশ হাসিখুশি, স্মার্টও। ভাবী, মহিলা কিন্তু ডিভোর্সি! আরে বলেন, এমন মহিলার সাথে থাকবে কে? বেলেল্লাপনা করে কলিগদের সাথে ঘুরে, একা সব সামলায়, ঠিকই আছে। চরিত্র খারাপ ভাবি, বুঝলেন, মহিলা ভালো না“; কী আর বলবো, স্বামীর নোংরামিতে সায় না দিয়ে লাথি মেরে একা থাকছেন, নিজের মতো দাঁত বের করে হাসছেন, উনি তো খারাপই!
এই দুনিয়াতে “মেয়ে” এক অদ্ভুত চিড়িয়া। এক অদ্ভুত জাতি!
মেয়েরা নিজেদের পছন্দমতো পোশাক পরলে দোষ।
মেয়েরা ফর্সা হলে দোষ, মেয়েরা কালো হলে তো শুধু দোষ না জেল, ফাঁসী।
মেয়েরা চ্যালেঞ্জিং পেশায় থাকলে দোষ, মেয়েরা পেশার খাতিরে রাতে ঘরে ফিরলে দোষ।
মেয়েরা ইজিগোয়িং হলে দোষ (সবসময় দোষ না, প্রেম করার ক্ষেত্রে সবাই চান প্রেমিকা যাতে ইজিগোয়িং টাইপ হোন), বিয়ের সময় এটা বিশাল দোষের।
মেয়েরা বিয়ের পর ঘাড় তুলে কথা বললে দোষ, মেয়েরা বেশি পড়াশুনা করলে দোষ, আবার মুর্খ হলেও দোষ,প ড়ালেখাকে কাজে লাগিয়ে ক্যারিয়ার করতে চাইলে আরো দোষ।
মেয়েরা অফিস করে ঘরের কাজ করে জিহবা উল্টায় মরে পড়ে থাকলে সেটাও দোষ!
মেয়েদের পেছনে হাজার ছেলে লাইন দিয়ে পাত্তা না পেলে, মেয়ে প্লে গার্ল। মেয়ে একজনকে মন দিয়ে সেই প্রেম ভাংলে মেয়েই ঠকবাজ।
মেয়ের জন্যই সুখের সংসারে ফাটল ধরে, সংসারে তার তদারকি না থাকলেই ছেলেমেয়ে উচ্ছন্নে যায় ।
সব দোষ এই নারী জাতির, পান থেকে চুন খসলেই নারীকুল খারাপ, দুশ্চরিত্রা, রূপ দিয়ে চোখে ধাধা লাগিয়ে কাজ হাসিল করে, হ্যান ত্যান।
আচ্ছা ,ভালো নারীর সংজ্ঞা ঠিক কী আপনাদের কাছে?
পা থেকে মাথা পর্যন্ত লজ্জাবতী গাছের মতো বিনয়ী, একটা লাথি খেয়ে মাথা না তুলে আরো পাঁচটা লাথি খেয়েও যে নারী চুপ থাকেন, যার প্রধান কাজ জন্ম নেয়া, ভালো লেখাপড়া করে সংসার করা, বাচ্চা দেয়া, জীবনে প্রেম না করা, করলেও একমাত্র তাকেই বিয়ে করার প্রাণপন চেষ্টা করা, বিয়ের পরে সংসারে অশান্তি আসলেও সেই সংসারেই বসে থাকা এবং সারাজীবন দুনিয়ার যতো খোটা আছে, সব শুনে জীবন পার করে দেয়া ………এমন মেয়েই নিশ্চয়ই আপনাদের চোখে ভালো মেয়ে?
প্রিয় পাঠক, আপনাদের মাথাটাকে একটু ঝাঁকান, খারাপ ভালোর এই সাঁকোর মাঝে নিজের বিচার বুদ্ধিকে, বিবেকটাকে হাত চেপে ধরুন। “মেয়ে“ র জায়গায় “মানুষ” ভাবুন। ভাবুন তো , লেখাপড়া শিখেও কিলগুতা খেয়েও সারাজীবন অন্যকে সমীহ করে যাওয়া, মানিয়ে চলা মানসিক দিক থেকে পঙ্গু হয়ে থাকা কোন মানুষকে আপনি ভালো বলবেন? নাকি জীবনকে জীবনের মতো করে চালিয়ে নেয়া কোনো মানুষকে ভালো বলবেন?
আপনাদের জেনে রাখা ভালো ,মেয়েদের এই দুনিয়াতে ছেলে পটানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করার আছে। মেয়েরাও দু হাতে কাজ করতে পারে, কোন মেয়ে ইচ্ছা করে তার সম্পর্ক ভাংগে না। এটা জেনে রাখেন বিছানাতে যাওয়া মেয়ে মানেই বেশ্যা না।
বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, নিজের প্রেমিকাকে চুমু খাননি কখনো তীব্র আবেগে? কোন মেয়ে সে যতোই ক্যারিয়ারিস্টিক হোক না কেন, বিয়ের পর সংসারকে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেয়, এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, সংসার তার দ্বারা হবে না আর যে মেয়ে ডিভোর্স নেয়, ভেবে নেবেন না সে গীতিনাট্য করে করে ডিভোর্স নিয়েছে, দেয়ালে পিঠ যখন ঠুকে যায়, সে সময় ছাড়া কোনো মেয়ে ডিভোর্স নেয় না, কারণ এই সমাজ সবাইকে ভাত দেয়, দাম দেয়, ডিভোর্সিদের দেয় না।
তাই কথায় কথায় একজন মেয়ের জীবনকে না জেনে তাঁকে কখনোই দুশ্চরিত্রা বলবেন না , কখনোই বলবেন না যা পেয়েছে তার সবটাই তার অন্যের দয়ায় পাওয়া, তার জীবনটা সে পার করছে, তার জীবনের ঝড় আপনি তো সামাল দেননি, তাই কথা বলার আগে ভেবে কথা বলবেন।
এতো কেন বৈষম্য আপনাদের চিন্তা ভাবনায়? নারী-পুরুষ না ভেবে মানুষ ভাবুন, ভাত খাবার জন্য হাতটাকে কানের পেছনে না পেঁচিয়ে সরাসরি মুখে ঢুকিয়ে দিন, এতেই মঙ্গল হবে।
ধন্যবাদান্তে,
একজন গর্বিত খারাপ মেয়ে, কারণ আমি তথাকথিত ভালো মেয়ে নই তাই ।