চল্লিশের বন্ধুরা ভালো থেকো

শাশ্বতী বিপ্লব:

(চারদিকে বড্ড বেশি ভাঙ্গনের শব্দ। বন্ধুরা কেউ কেউ, হয়তোবা অনেকেই ভালো নেই। মুখে না বললেও হাসিমাখা মুখের উপর বিষন্ন, ক্লান্ত চোখদুটো বলে দেয় মন খারাপের খবর। প্রাণপনে জীবনের চ্যালেঞ্জটা সামলানোর চেষ্টা করছে বুঝতে পারি। সম্পর্কের টানাপোড়েনটা টের পাওয়া যায় কারো কথায় বা লেখায় কখনো সখনো। কিন্ত গায়ে পরে জানতে চাওয়া হয়না কারণটা। কেউ নিজে থেকে না জানালে সেটা  কিছুটা অনধিকার চর্চাও বটে। সেই বন্ধুদের জন্য এই লেখাটা।)

এতোদিনের চেনা মানুষটা হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠলে কারই বা ভালো লাগে। নিত্য খিটিমিটি, অকারণ তুলনা, মনগড়া সন্দেহ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, ব্লেইম গেইম বা অন্য নারীর প্রতি আগ্রহের মতো পরিবর্তনগুলো নিয়ে হিসাব কষতে বসি আমরা অনেকেই, সমীকরণ মেলাই নিজের মতো করে। এই পুরনো আমাকে আর ভালো লাগে না তবে – এরকম একটা উপলব্ধি থেকে অভিমান, রাগ, ক্ষোভ জেঁকে ধরে। অথবা টালি মেলাই “পুরুষ মানুষের” চিরাচরিত চরিত্রের সাথে। নিজেকে প্রতারিত মনে হয়।

আমরা যারা মাঝবয়েসী তাদের অনেকেই হয়তো এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি বা যেতে পারি। কিন্তু সবক্ষেত্রেই হিসাবটা পুরুষের গতানুগতিক বদমাইশি বা চারিত্রিক স্খলনের মতো জলবৎ তরলং নয়। বরং কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা এক ধরণের তীব্র মানসিক সংকট যেটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। কিন্তু একটু সচেতনভাবে চেষ্টা করলে সেই সংকট থেকে বের হয়ে আসা/ বের করে আনা সম্ভব। তাই জেনে রাখা ভালো।

বলছি মিড লাইফ ক্রাইসিস বা মাঝবয়সের সংকটের কথা। পৃথিবীতে বহু পুরুষ তার চল্লিশ বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে এসে এই সংকটে ভোগে। নিজের জীবনকে পিছন ফিরে দেখতে চায় এবং হতাশায় আক্রান্ত হয়।তারা মনে করে তাদের আরো ভালো কিছু হওয়ার, অন্য কিছু পাওয়ার কথা ছিলো। জীবন তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। এই হতাশা বোধ থেকে তারা পরিত্রাণ চায়। তড়িঘড়ি করে বদলে ফেলতে চায় জীবনটাকে। পরিবার ও স্বজনদের (বিশেষ করে স্ত্রীকে) তখন প্রধান প্রতিবন্ধক বলে মনে হয়।  

মিডলাইফ ক্রাইসিসের লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:

১. চল্লিশ বছরে পদার্পণ করে বা কাছাকাছি সময়ে নিজেকে নিয়ে মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন তৈরি হওয়া। 

২. জীবনের মুখ্য বিষয়গুলো, যেমন, পেশা/ ক্যারিয়ার, বিবাহিত জীবন, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে হতাশা তৈরি হওয়া এবং সেগুলো ঠিক করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা।

৩. তীব্রভাবে অনুভব করা, এইগুলো ঠিক করে নেয়ার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এবং এই অনুভূতিটাই সবচেয়ে বিধ্বংসী।

পরিবর্তনের জন্য এইসময় এতোটাই মরিয়া হয়ে ওঠে যে সে অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। নিজের ভিতরে কিশোর বয়সের বিদ্রোহ অনুভব করে। সবকিছু এক লহমায় বদলে ফেলতে চায় যেন সে জীবনের ফাঁদে আটকা পড়েছে। নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, নিজের পরিবারকে ত্যাগ করে, নিজের চেহারা নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে ওঠে কিংবা অতিমাত্রায় এডভেঞ্চার প্রিয় হয়ে ওঠে।

এইসবই তার নিজের সহ কাছের মানুষগুলোর জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। এলোমেলো আচরণ ও অবেবিবেচক সিদ্ধান্ত লণ্ডভণ্ড করে দেয় চারপাশটা। এই ঘোর একসময় কেটে যায় ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। কাছের মানুষেরা চলে গেছে বহুদূর। ফিরতে চাইলেও আর ফেরার উপায় থাকে না। শেষপর্যন্ত এরা নিজেরাও ভালো থাকে না,  এবং অন্যকেও কষ্টে রাখে।

এই ধরণের সংকটে ভালো সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিত। কথা বলা উচিত নির্ভরযোগ্য কোন বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে। সঠিক কাউন্সেলিং, সহমর্মিতা, ভালোবাসা এই মানুষগুলোকে (এবং আপনাকেও) সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে ফেরাতে পারে।

স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে, মিড লাইফ ক্রাইসিস কি শুধু পুরুষেরই হয়? মেয়েদের হয় না? উত্তর হলো, হয়। মেয়েদেরও হয়। তবে সেটা পুরুষের মতো এতোটা বিধ্বংসী হয় না। পুরুষদের মধ্যে সবকিছু রাতারাতি বদলে ফেলার যে আকুতি থাকে, নারীদের বেলায় সেটা বেশ কম।  সেটা অবশ্যই পুরুষের আজন্ম লালিত সামাজিক ও মানসিক সুপিরিয়র অবস্থান (এবং মাইন্ডসেট) এবং মেয়েদের ইনফিরিয়র অবস্থানের কারণে।

মেয়েরা এমনিতেই ছোটবেলা থেকেই নিজের চাওয়া পাওয়াগুলোকে অন্যের চাহিদা অনুযায়ী মিনিমাইজ/ কাস্টমাইজ করতে শেখে বা বাধ্য হয়। তারা ধরেই নেয় তাদের বেশিরভাগ চাওয়া পূরণ হবে না বা হওয়ার উপায় নেই। তাই শুধুমাত্র  নিজের অস্তিত্ব বা পরিচয় নিয়ে, বা সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে  আলাদা করে কোন সংকট তাদের ঠিক বাগে আনতে পারে না। আর সম্পর্ক নিয়ে সংকটগুলো তারা অধিকাংশ সময় নিজের কাছ থেকেও লুকানোর চেষ্টা করে।

মাঝ বয়সে একজন নারীর জন্য পরিবারে কেয়ার গিভিং এর দায়িত্ব পুরুষের তুলনায় বেশি থাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, নির্ভর করে বাঁচে সন্তানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাই মাঝবয়সী নারীর এসবকে পাত্তা দিলে চলে না। ফুসরতও খুব একটা পায় না। আর তাছাড়া, অধিকাংশ নারী নিজেকে ছাপিয়ে নিজের পরিবারকে আগে রক্ষা করার চেষ্টা করে, যেটা পুরুষদের চাওয়ার চাইতে কিছুটা ভিন্ন। অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাও হয়তো একটা কারণ।

এর বিপরীতে না পাওয়ার অনুভূতি থেকে অধিকাংশ পুরুষ প্রধানত নিজেকে দেখতে পায় এবং সবকিছু জট পাকিয়ে ফেলে। এর ব্যাতিক্রমও আছে, তবে খুবই নগন্য।

মিড লাইফ ক্রাইসিস বা মধ্যবয়সের সংকটকে বোঝাটা খুব জরুরি। আপনি চাইলে প্রিয় মানুষটিকে এই সংকট থেকে বের হতে সাহায্য করতে পারেন।

আরো পড়ুন নিচের লিংক কিংবা গুগল করে জেনে নিন।

http://www.webmd.com/men/features/mens-midlife-crisis

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.