নন্দিতা (ছদ্ম নাম):
কাল রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। সব কিছু এত জটিল হয়ে আসছে দিনের পর দিন। জানি, আমার এই মন খারাপের কারণ আমার অতিরিক্ত প্রত্যাশা। কেননা, এভাবেই আমি শিখেছি যে একসাথে থাকতে হলে সবার মন যুগিয়ে ভালভাবে থাকতে হয়। কিন্তু দিনের পর দিন সেই একসাথে থাকাটা আমার অস্বস্তির কারণে পরিণত হচ্ছে।
এতো চেষ্টা করেও মন পাচ্ছি না সেই বাড়িতে, যেখানে বাকি জীবনটা কাটাবো বলে অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম। বেশি দিন হয়নি এখানে, একটি বছর। কিন্তু একটি বছরে অনেক কিছু দেখলাম। দেখলাম মানুষ কিভাবে অন্য পরিবার থেকে আসা একটি মেয়ের থেকে আকাশ কুসুম প্রত্যাশা করে যেতে থাকে। আমি তবুও চেষ্টা করেছি, কিংবা বলতে পারেন করে যাচ্ছি, কিন্তু দিন শেষে দেখা যায় তাঁরা কখনোই সন্তুষ্ট হয়না।
সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে যখন আমার মা-বাবাকে এখানকার মানুষরা ছোট করেন। আমার দিকটা কখনোই দেখেন না এরা। আমি কতটা কষ্ট পাচ্ছি সেটা কেবল আমি জানি, আর জানেন আমার মত পরিস্থিতিতে যারা আছেন কিংবা এক সময় এর মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। আমার মা বাবাকে এক সময় ওয়াদা করে আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল যে, আমি যেমনই হই না কেন, তাঁরা ভাল হয়ে দেখাবেন যে এখনও সমাজে এমন শ্বশুর বাড়ির লোক আছেন। কথাটা বিয়ের আগে আমার ভাল লেগেছিল। আসলে, বিয়ের আগের সময়টাই এমন যে তখন সব কিছু ভাল লাগে।
আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও অন্যরকম ভাল লাগার ছিল, কেননা বিয়েটা আমার সম্বন্ধ করে হয়েছিল। তখন পৃথিবীটা অনেক ভাল লাগার একটি ক্ষেত্র বলে মনে হত। কিন্তু ধীরে ধীরে সব চিত্র কেমন পালটে গেল। আমার জন্য সব নিয়ম অন্যরকম হয়ে গেল। একসময় আমার পেশাগত পরিচয়ে তাঁরা বেশ গর্ববোধ করতেন, কিন্তু ইদানিং দেখছি আমার সেই পেশাও তাঁদের ভাল লাগছে না।
আমার কর্মস্থলে যাবার রুটিনটাও যেন সবার অপছন্দ। উফ! সত্যি, রাগ দমন করাটা মাঝে মাঝে খুব দুষ্কর মনে হয়। আমার পেশাটাই এমন যে, খুব মন স্থির করে কাজ করতে হয়। অনেক একাগ্রতা প্রয়োজন, প্রয়োজন মানসিক স্থিরতার। কিন্তু যখন পারিবারিক অযথা ঝামেলার জন্য মন অশান্ত থাকে তখন মনে হয় আমি আমার পেশার সাথেও অন্যায় করছি। কেননা আমার মেধার উপর আস্থা রেখে এমন একটি অবস্থান আমাকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার মানসিক অস্থিরতা দিন দিন আমার কাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মা-বাবাকে একসময় মজা করে বলেছিলাম যে এই ধরনের পেশার মেয়েদের বিয়ে করা উচিৎ না, ইদানিং মনে হচ্ছে, এটাই বোধহয় ঠিক ছিল।
বেঁচে থাকাটা খুব সুন্দর। আমার কাছে জীবন সৃষ্টি কর্তার দেয়া সবচাইতে বড় উপহার। কিন্তু এমন জীবন তো আমি চাইনি। বিয়ের আগে আমার মা-বাবা বলেই নিয়েছিলেন যে আমার মেয়ে তার পেশার সাথে কোন আপোষ করবেনা। আমিও বলেছিলাম এই কথা। তখন আমার নতুন পরিবারের লোকেরা আমার পেশার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সম্মান দেখিয়েছিলেন, কিন্তু বিয়ের পর প্রতিদিন আমার বাইরে যাওয়াটা আমার নতুন বাড়ির লোকদের অস্বস্তির কারণে পরিণত হতে শুরু করেছে ইদানিং। হয়তো তাঁদের প্রত্যাশা ছিল যে একসময় আমিই সব ফেলে গৃহবধূ হয়ে আমার বাড়ির লোকদের সেবা করব।
আমি যদি বলি, আমার কাছে আমার জীবন থেকে প্রত্যাশাটা খুব সাধারণ। নিজের স্বাধীনতা ও পরিচয় অক্ষুন্ন রেখে সবাইকে নিয়ে আনন্দময় সুন্দর একটা জীবন – যা কিনা একেবারেই অসম্ভব। হ্যাঁ, বিয়ে না করাটাই হয়তো উচিৎ ছিল, কিন্তু তখন মা-বাবার কথার অবাধ্য হতে পারিনি। এখনও মা-বাবা চান, আমি আর একটু চেষ্টা করি, কিন্তু এভাবে চেষ্টা করাটা খুব ক্লান্তিকর মনে হয় আমার কাছে, কেননা আমি জানি আমি কেবল দেয়ালে বল প্রয়োগ করে সেটাকে সরানোর অনর্থক চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিনা। যাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি তাকে ফেলেও চলে যেতে পারছি না। আচ্ছা! কেন আমার জীবনসঙ্গী বুঝতে পারে না যে এই অনন্ত অপেক্ষা আমাকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে দিচ্ছে। তাকে সব বলেছি, কিন্তু তাঁর ধারণা, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি খুব ভালভাবে জানি যে, আমার মন এভাবে নষ্ট হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে এই চেষ্টাটাও আর বেশিদিন করানো যাবে না। আমিও অনেক কঠোর মনের মানুষ। আমাকে করা প্রতিদিনের অপমানগুলো আমিও ভুলে যাবো না।
শেষ করছি আজ একটি ছোট কথার মধ্য দিয়ে। আমার এই বাড়িতে ভারতীয় সিরিয়াল খুব জনপ্রিয়। নানা সিরিয়ালের নানা নায়িকার গুণ/দোষ নিয়ে বেশ আলোচনা হয় বসার ঘরে (যেটা খুব বিরক্তিকর)। এগুলো দেখবার সময়, প্রায়ই শুনি কিছু টিপ্পনী, ধরুনঃ ইশ!! আমাদের ঘরের বউ যদি এমন হতো! মাঝে মাঝে খুব উচিৎ জবাব দিতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু তখন ভাবি, যাদের প্রত্যাশা একটা বাক্সের নানান রঙের মধ্যে বন্দী, তাঁদের সাথে তর্ক করাটাও হয়তো নিরর্থক।