শামীম রেজা খান ও জিন্নাতুন নেছা:
শিক্ষানবিশ গবেষক হওয়ার সুবাদে দেশের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ আসে। জানার, দেখার সুযোগ পাই নানান মানুষের নানান সংস্কৃতি, আচার,কৃষ্টি-কালচার সবই। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা……
সম্প্রতি এক গবেষণা কাজে গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গে। রংপুর জেলার বেশ কিছু গ্রাম ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। নারীদের অসচেতনতা দেখে বাকহীন হয়ে যাই। পেপার,পত্রিকা,টেলিভিশন এমনকি নানা এনজিও’র প্রোগ্রামের মাধ্যমে যখন বলা হচ্ছে, নারীরা বাংলাদেশের উন্নয়ের অংশীদার, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। আবার নারীদের ক্ষূদ্র ঋণের মাধ্যমে করে তোলা হচ্ছে আত্ম-নির্ভরশীল। কিন্তু দেখা যায় সেই নারীরাই তার পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
নারী পারে কেবল আজ কী দিয়ে ভাত রান্না হবে, ছেলে বা মেয়েকে কী খাওয়ানো হবে তার সিদ্ধান্ত নিতে। কোন এক গবেষণা কাজে আমার এক উত্তরদাতা লিপি (ছদ্দনাম) আমাকে বলেছিলো,”মাইয়াগো বিয়া হলে মাইয়ারা কি সব সিদ্ধান্ত নিতে পারে আপা?” আবার মেয়েরা বিয়ের আগে বাবার বাড়িতে থাকা অবস্থায় কি কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে? আমার মনে হয়েছে মেয়েরা কোন সময়েই নিজের সিদ্ধান্ত এককভাবে নিজে নিতে পারে না।
একটা ঘটনা বলি: এক গবেষণা কাজের জন্য এক গ্রামে এক বাড়িতে গিয়েছি ঐ বাড়ির মা এবং মেয়ের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলাম এক হ্যাংলা, ছিপছিপে ছেলে (বয়স আনুমানিক ১৬-১৮ হবে) দাঁড়িয়ে আছে। এরপর আমাদের একনাগাড়ে জিজ্ঞাসা করা হলো আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, বাড়ি কোথায় ব্লা ব্লা। আমরা তার প্রশ্নের যথোপযুক্ত উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলাম। কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম একটু দূরে ঘরের এক কোনে দুজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছিলো তারা কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত। ঘটনা পরম্পরায় আমরা জানলাম তারা তার মা আর বোন।
আমি বললাম, চাচি আমরা আপনাদের সাথে একটু কথা বলতে চাই। আমার কথার প্রতিউত্তরে বাড়ীর সবথেকে বয়স্ক ব্যক্তিটি মুখ দিয়ে কোন শব্দ না করে, কথা না বলে কেবল ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন তার ছেলেই সব এবং সে যা বলবে তাই হবে। আমরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম এ কোন পৃথিবীতে আমাদের বাস, যেখানে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া (এক ফাঁকে ছেলেটির বায়োডাটা নিয়েছিলাম) এক ছেলের সাথে মায়ের কথা বলার সাহস নাই। তিনি (ছেলে)পরিবারের কর্তা। তার সিদ্ধান্তই সব।
আর একটি বাড়িতে গিয়েছি তাদের মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য। মেয়েটির মা (বিধবা) বললো, “হামি কি কমু মা, হামার ত সোয়ামি নাই, মোর বড় ছেলে যা কবে তাই হবি। হামি কি কতা কতি পারমু মা। কতা কলি কবি তুমি দেওয়ান হচ না দ্যাও দেকি তোমার বেটিক বিয়া।” এই বাড়িতেই ইন্টার পাশ করা এক বোনের বিয়ে দিচ্ছে ভাইয়েরা ৫ম শ্রেণী পাশ করা ওয়েল্ডিং মিস্ত্রীর সাথে, যেখানে মা এবং মেয়ে দুজনেই নিরুপায়, তাদের কিছুই করার নাই। মেনে ত নিতেই হবে।
নারী কতদিন আর মুখ বুঝে মেনে নিবে? নারী কবে হবে সচেতন? কবে নারীর মাঝে জেগে উঠবে আত্মসম্মানবোধ? নারী কবে হয়ে উঠবে পরিবারের কর্তার সমতুল্য? কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্তা ত বটেই। মজার বিষয় হলো, নারীর স্বামী থাক আর না থাক কোন পরিবারেরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা নারীর হাতে থাকে না। স্বামী থাকলে স্বামী নিজেই যেন সব বিষয়ে সর্বেসর্বা আর স্বামী না থাকলে ছেলে, ভাই, মেয়ের জামাই, ভাসুর, দেবর এরা কর্তার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু কেন একজন বাইরের মানুষ এসে তার পরিবারের সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে? আমার প্রশ্ন নারী কেন এই সুযোগ দিচ্ছে?
অনেকে বলবেন এটা আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মগজ-ধোলাই যেখানে যুগ যুগ ধরে নারীর অস্থিমজ্জাতে এই ধ্যানধারণা সেঁটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি বলবো পরিবর্তনের সময় এসেছে। নারীকে পাল্টাতে হবে, নিজের অধিকার নিজে আদায় করে নিতে হবে। আমরা পুরুষের সমকক্ষ হতে চাই না বা আমরা তাদের মতো হতে চাই না। আমরা চাই মানুষ হিসেবে আমাদের ন্যায্য অধিকার। যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতার এজেন্ট “পুরুষের” বিরুদ্ধে লড়তে হবে, হচ্ছে।
আবার নারীর প্রতি তৈরিকৃত যত বৈষম্য সব এই সমাজেরই নির্মিত। তাই আমি মনে করি নারীদের পুরুষতন্ত্রের এজেন্ট, সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। যার জন্য প্রথমেই যা দরকার তা হলো গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সকল নারীদের সচেতন হতে হবে, নারী যে নিজে নিজেই কারো সাহায্য ছাড়া কোন কিছু করতে পারে এটা নারীকে ভাবতে হবে। দেখিয়ে দিতে হবে নারীকে, নারীরাও পারে। নারীর মাঝে আত্ম-সম্মানবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। নারীকে ভাবতে হবে “আমি মানুষ আর আমি সবকিছু করতে পারি”। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী অধিষ্ঠিত সেদেশে কেন এক শ্রেণীর নারী থাকবে এতো অবহেলিত!
বিশেষ শ্রেণী বলতে আমি বুঝাতে চেয়েছি গ্রাম বাংলার ঐ সকল নারী যারা পড়ালেখা জানে না, জানলেও টুকটাক। তারা ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ পায় খুব কম। বলা যায়, তাদের হেজেমনিক প্রক্রিয়ায় আটকে রাখা হচ্ছে। বাইরের জগত সম্পর্কে তাদের জানাশোনার সুযোগ খুব কম।
এখন উইমেন চ্যাপ্টার, সিস্টার হুড, উইমেন ওয়ার্ল্ড প্রভৃতি নানা মাধ্যমে নানান লিখা বের হচ্ছে। আমার প্রশ্ন হলো ঐ সকল নারীরা কি আদৌ এসব পড়ার, দেখার বা এসব থেকে জ্ঞান লাভের সুযোগ পাচ্ছে? হয়তো পাচ্ছে কিছু অংশ, যার পরিসংখ্যান খুব কম। এসবের জ্ঞান কেবল কিছু শ্রেণীর নারীর মাঝেই সীমাবদ্ধ। যা সর্বস্তরের নারীর মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি তা পারছি? আমি যদি আমার নিজের পরিবারের দিকে তাকাই আমি বলবো, আমি পারিনি আমার মাকে সচেতন করতে। আমি এখনো দেখি আমার মা নিজে ইলিশ মাছ না খেয়ে আমার বাবাকে খাওয়ায়, আর একই সময়ে আমার মা খায় অন্য কোন মাছ দিয়ে ভাত। কারণ আমার বাবা ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করেন। এমন নয় আমার বাবার টাকার অভাব, কিনতে পারেন না তাই মা নিজে না খেয়ে বাবাকে খাওয়ায়।
এরকম অনেক পরিবার আছে যেখানে নারী নির্যাতন হচ্ছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু নারী যেন ভাবছেই না এগুলো তাদের উপর এক ধরনের নির্যাতন। নারীর এই বোধ কবে জাগ্রত হবে? কবে নারী বুঝতে শিখবে, বিশ্বাস করতে শুরু করবে স্বামী যে জায়গায় মারে, সে জায়গা আসলে বেহেশতে যায় না। এগুলো সামাজিক নির্মাণ। যার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারী নির্যাতনকে বৈধতা দেয়ার প্রচেষ্টা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের মত কৃষিপ্রধান দেশে গ্রামে বাস করে প্রায় ৭০% লোক। যার মাঝে প্রায় ৪০%নারী এবং ৩০% পুরুষ।
এই সকল নারী কি আদৌ এসব পড়ার, জানার বা বোঝার সুযোগ পাচ্ছেন? এখন প্রশ্ন হতে পারে এই বৃহত্তর সংখ্যক নারীকে নারী উন্নয়নের সমঅংশীদার না করে কিভাবে নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন বা স্বাধীনতা দেয়া সম্ভব? আবার মাথার মধ্যে একটি কথা কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো নারী উন্নয়ন মানেই কি নারীর স্বাধীনতা?
যেমন: “দুই হাড়ি একসাথে থাকলে ঠুকাঠুকি লাগবেই, স্বামী যে জায়গায় মারবে সেই জায়গা বেহেশতে যাবে, স্বামীর হাতে ডাঙ (মাড়) খাইলে সওয়াব হয় ব্লা ব্লা ব্লা। আমি জানি এসবের প্রতিউত্তর হবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যুগ যুগ ধরে নারীর মগজে এসব সেঁটিয়ে দিয়েছে। যেগুলো এখন হয়ে গেছে সামাজিক প্রথা, পাচ্ছে বৈধতাও।
আমি এখানে বলতে চাই দলীয় আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সকল নারী ছিলো ক্ষুদ্র ঋণের সাথে যুক্ত। তাহলে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী কিছুটা হলেও এই সকল নারী, নারী উন্নয়নের অংশীদার। মুষ্টিমেয় কিছু উদহারণ বাদ দিলে প্রায় সকল নারী বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তাদের স্বামীর হাতে সব টাকা তুলে দেয়।
আমার বিভিন্ন গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, নারী টাকা জমায় খেয়ে না খেয়ে আর সেই টাকা নিজের শখ -আহ্লাদে খরচ করে না। নিজের পছন্দের একটি শাড়িও কিনেন না। খরচ করেন ছেলেমেয়ের জন্য, স্বামীর কোন বিপদের জন্য। কিন্তু মজার বিষয় হলো ঐ নারীরই কোনো অসুখ হলে সে তার চিকিৎসা সেবাও পায় না ঠিকমতো। বলা হয় বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে।
আমার প্রশ্ন হলো, নারীর হাতে টাকা আছে, নারীর উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা আসলে কোথায়? নারী স্বাধীনতা কোথায়? নারীর ক্ষমতায়ন কোথায়? নারী উন্নয়ন বলুন, আর ক্ষমতায়ন বলুন, তা হয়ে উঠুক সকল নারীর জন্য সমভাবে, সমস্তরে। সর্বোপরি নারী হয়ে উঠুক সচেতন, আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন আর আত্ম-নির্ভরশীল। নারী বলুন আর পুরুষ বলুন প্রতিটি মানুষ যদি তার নিজ নিজ জায়গা বা ঘর থেকে জেন্ডার সচেতন হয় তাহলে নারী উন্নয়ন,ক্ষমতায়ন আর নারী স্বাধীনতা তা হয়ে উঠবে সকল স্তরের নারীর জন্যই সমভাবে।
শামীম রেজা খান, জিন্নাতুন নেছা।
নৃবিজ্ঞানী, গবেষক, লেখক।