মাতৃত্ব বনাম মনুষ্যত্ব, বনাম সমাজ

জেসমিনা হক:

ঘটনা- ১

ঈদে বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্টে নারীটির মৃত্যু হয় গাড়িতে পুরো পরিবারই ছিলতিন ছেলে আর তার স্বামী বেঁচে যায়, আর ওই নারী ঘটনাস্থলেই মারা যানবড় ছেলের বয়স তখন ১০+, আর সবার ছোটটির বয়স চার বছর মৃত্যু একটি কঠিন সত্য, যারা বেঁচে থাকে, তারা পুনরায় বাঁচার তাগিদেই বাঁচতে শুরু করে

ঐ ঘটনার ছয়মাস পর তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন বলা বাহুল্য, একটু গরীব পরিবারের মেয়ে হলেও দ্বিতীয় স্ত্রীটি দেখতে আগের স্ত্রীর চেয়ে আরো সুন্দরী ও কম বয়সীও বটে! এখন সবার কথা, ঠিকই তো, ভদ্রলোক কী করবে? নিজের ব্যবসা সামলাবে? নাকি বাচ্চাদের দেখবে? বিয়ে না করে উপায় আছে?  লোকটির বয়স প্রায় ৪০হবেদ্বিতীয় বিয়ের দু’বছরের মাথায় দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরেও আরেকটি সন্তান এলো

আর যে সন্তানদের দোহাই দিয়ে বিয়ে, সেই তিন সন্তানের বড়টিই তার ছোট দুই ভাইকে দেখেমাছ ভাজা, ডিম ভাজি, ভাত ফুটানো সবই শিখে গেছে এই দুই বছরে ছেলেটির বাবা প্রতিদিন সকালে ছেলেটির হাতে বেশি করে টাকা দেয়, যা কিছু লাগবে তা যেন ছেলেটি কিনে নেয়ছেলেটির যা আসলেই প্রয়োজন তা কী সে টাকা দিয়ে কিনতে পারে!

ছেলেটি আমার ছেলের বন্ধু আর ক্লাসমেটওর হারিয়ে যাওয়া মাকে আমি দেখেছিআমি দেখছি আমার ছেলে যেখানে সবকিছুর জন্যই আমার উপর নির্ভরশীল, ঠিক তখনই বাস্তবতার নির্মমতায় সমবয়সী আরেকটি ছেলে কেমন দায়িত্ববান হয়ে উঠেছে এই তের বছর বয়সেই

ঘটনা -২

মেয়েটির বয়স খুব বেশি হলে ৩৬ বছর হবেওর স্বামী আমাদের অফিসে পিয়ন পদে চাকরি করতোহঠাৎই স্ট্রোকে স্বামীটি মারা যায়তারও তিন সন্তান, বড় ছেলেটির বয়স ১১ বছর আর ছোটটার তিন বছরস্বামীর মৃত্যুর পর অনেক বলেকয়ে কর্তৃপক্ষের অসীম কৃপায় মেয়েটির ডেইলি বেসিসে চাকরি হয়যেহেতু ডেইলি বেসিসে চাকরি, তাই এবসেন্ট করলেই টাকা কাটেতিনটি বাচ্চা সামলে সে কোনরকম করে দিন টানছেসবাই তাকে বুঝায় কী করবা, তোমার ভাগ্য; কষ্ট করোভুলেও বিয়ের কথা কেউ তাকে বলে না

তবে হ্যাঁ কেউ কেউ তথাকথিত ভালো লোক অফিসে আছে, তারা প্রথমদিকে চেয়েছিল মেয়েটি যেন তাদেরকে একটু সেইভাবে খুশি করে, তাহলে তাকে চাকরিতে একটু সুবিধা দেয়া যাবেকিন্তু মেয়েটি তাতে রাজি হয়নি। তাই তার চাকরিতেও এখন অনেক সমস্যা! একটু আধটু ভুল হলেও সে এখন আইনের ফাঁকে পড়ে শাস্তি পায়

উল্লেখিত দুটি ঘটনাই আমার চোখের সামনে দেখাদ্বিতীয় বিয়ে প্রথম ঘটনায় সমাজের সবার সমর্থন প্রাপ্ত, আর দ্বিতীয় ঘটনায় নয়অথচ ৪০ বছর বয়সী লোকটির শরীরের প্রতি কতজন নারী লোলুপ দৃষ্টিতে দেখেছে আমার জানা নেই, কিন্তু ৩৬বছর বয়সী মেয়েটির শরীর হাজার হাজার চোখ লোলুপ দৃষ্টিতে দেখে

মেয়েটির রাত কাটে কীভাবে সেই দুঃখে দুঃখিত সবাই! কিন্তু সে বিয়ের কথা ভাবলেইঅসভ্য মহিলা!!! তিন বাচ্চা নিয়েও তার আবার বিয়ে লাগে!! আর বয়স হয়েছে না এখন! আল্লাহ্ বিল্লাহ্ করবা, সন্তানদের মানুষ করবাতোমার আবার কোনো চাওয়া আছে নাকি!! ছেলেমেয়ে মানুষ হওয়াটাই এখন তোমার চাওয়া

আর শুধু পুরুষরা নয়, এই কথাগুলো অধিকাংশ নারীর মুখেও বলতে শুনিআর বাবা সন্তান রেখে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু মা কেন করবে?

ঘটনা- ৩

স্বামীস্ত্রীর মধ্যে বিন্দুমাত্র সুসম্পর্ক নেইস্বামী প্রবরটি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত এবং এই সন্দেহ থেকে স্ত্রীর সাথে যত রকম দুর্ব্যবহার পারে সে করে, স্ত্রীর গায়ে হাতও সে তোলেস্বামীর সন্দেহের কারণ হলো স্বামীটির শারীরিক মিলনের অক্ষমতাস্বামীস্ত্রীর বয়সের পার্থক্য অনেক এবং বিয়ের প্রায় তের বছর পর থেকে স্বামীর যৌন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু স্বামী সেটা মুখে স্বীকার করে নাতাই যদিও কোন প্রমাণ পায়নি, তারপরও স্বামীটি তার স্ত্রীকে সন্দেহ করেতাদের বৈবাহিক জীবন প্রায় ১৭ বছর

অতিষ্ট হয়ে স্ত্রী ডিভোর্স নিতে চাইলে বাদ সাধে তাদের ষোল বছরের মেয়েটিমেয়েটি তার মাকে সাফ জানিয়ে দেয়,তোমার যতো কষ্টই হোক, তুমি বাবাকে ছাড়তে পারবা নাআমি তাহলে সুইসাইড করবোবাবাকে তো আমি কিছু বলতে পারি না, কিন্তু তোমাকে বলতে পারি, তাই তুমি ডিভোর্স নিতে পারবা না”। টিনএজার মেয়ে ইমোশনাল হয়ে যদি কিছু করে বসে, তাই স্ত্রীটির আর ডিভোর্স নেয়া হয় নাতবে ধীরে ধীরে স্ত্রীটি সাইকোলজিক্যাল পেশেন্ট হয়ে যাচ্ছে

আচ্ছামাকি শুধুই মা? সে কি রক্ত মাংসের মানুষ না? মাতৃত্বের পাশাপাশি তার আর কি কোন চাওয়া নেই? শুধু সমাজ নয় আমাদের দেশের সন্তানেরাও বাবা যদি নিজেকে নিয়ে ভাবে, সেটা যতটা মেনে নেয়, কিন্তু মায়ের ক্ষেত্রে সেটা মানতে নারাজ

আমি অনেক মাকে দেখেছি যারা নিজের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সন্তান, আত্মীয় আর সমাজের চাপে পড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন নাআত্মীয় আর সমাজের চাপ উপেক্ষা করতে পারলেও সন্তানেরটা পারেন না

সন্তানদের চাওয়া উপেক্ষিত হবার নয়, কিন্তুমাকে আমরা দেবী নয়, মানুষ হিসেবে কেন ভাবতে পারি না!! বাবাকে যদি ভাবতে পারি যে বাবাপরিচয়ের বাইরেও তার আরও সত্ত্বা আছে, সেই সত্ত্বার চাওয়া আছে; তবে মায়েরটা কেন নয়?

আমার ক্ষুদ্র ভাবনায় আমি এক্ষেত্রে মায়েদেরকেই দোষ দেইসন্তানের প্রথম সোশালাইজেশন বা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি শুরু হয় মায়ের হাত ধরেইমাতৃত্বের প্রাধান্যে আমরা সন্তানকে কখনো বুঝতেই দেই না শুধু মা নয়, মানুষ হিসেবেও প্রতিটি মায়েরও কিছু চাওয়া থাকেআমি অনেক উচ্চশিক্ষিত সন্তানদের বলতে শুনি,আমার মা মাটির মানুষ, তার কোনো চাওয়া নেইআসলেই কি তাই? সে (মা) তার চাওয়াটা প্রকাশ করে না হয়তো, কিন্তু চাওয়া থাকবে না কেন! বলিহারি সেই সন্তানের শিক্ষা!

সন্তান মায়েরই শরীরের অংশ, তাই হয়তো বাবা যেটা উপেক্ষা করতে পারে, মা সেটা পারে নাঅবশ্য ব্যতিক্রমও আছে, কিন্তু আমি অধিকাংশের কথা বলছিতবে মাতৃত্ব ছাড়াও মা কিন্তু একজন মানুষ, এবং মানুষ হিসেবে তারও অনেক চাওয়া থাকতেই পারে এই ভাবনাটা সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব কিন্তু প্রতিটি মায়েরই

আমার দেশের অধিকাংশ মা যেমন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তার অনেক চাওয়াকে বিসর্জন দিতে পারে ;ঠিক তেমনিভাবে আমার দেশের সন্তানেরাই হোক মায়েদের শক্তিমাতৃত্বের দায়বদ্ধতা নয়, মাকেও মা ছাড়া আলাদা সত্ত্বার মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখুন সন্তানেরাযে সমস্ত মায়েদের বাস্তবতার কশাঘাতে জীবন পাড়ি দিতে হচ্ছে, সন্তানই যেন তার মানসিক সহযোগী হয়নিজের জীবনে যেমন ভালবাসা, রোমান্টিসিজম বা শারীরিক চাহিদা রয়েছে; “মামা হলেও তারও এই চাহিদাগুলো রয়েছে, এই ভাবনাটা যেন আমরা আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পারিমাতৃত্বের দোহাই দিয়ে আমার বা আপনার মেয়েকে যেন তার অন্য সত্ত্বার গলা টিপতে না হয়

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.